🌹বি.এ সেমিষ্টার-৪::মেজর ইতিহাস(পেপার-৩)সাজেশন(PART-3)🌹

✍️প্রশ্নের মান-১০:

---

📝 ১. মার্কেন্টাইলবাদ কী? এর প্রকৃতি বা চরিত্র বিশ্লেষণ করো।

---

🟩 ভূমিকা :

১৬শ থেকে ১৮শ শতাব্দীর ইউরোপে রাষ্ট্রের শক্তি ও সমৃদ্ধিকে স্বর্ণ-রৌপ্যের সঞ্চয়ের সঙ্গে যুক্ত করে যে অর্থনৈতিক তত্ত্বের বিকাশ ঘটেছিল, তাকে মার্কেন্টাইলবাদ (Mercantilism) বলা হয়। এই নীতি অনুযায়ী একটি দেশের ধনসম্পদই তার রাজনৈতিক শক্তির মূলভিত্তি।

---

🟩 সংজ্ঞা :

‘মার্কেন্টাইল’ শব্দের অর্থ বাণিজ্যসংক্রান্ত। অর্থনীতিবিদ হিউসন বলেন—

“Mercantilism is that system of political economy which regards the wealth of a nation as consisting in the possession of gold and silver.”
অর্থাৎ, একটি দেশের ধন সম্পদের মানদণ্ড ছিল তার স্বর্ণ ও রৌপ্যের মজুদ।

---

🟩 উৎপত্তির পটভূমি :

• ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের পতন ও জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার উত্থান ঘটে।

• ভূগোল আবিষ্কার ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রসার নতুন অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে।

• এই প্রতিযোগিতায় ধনসম্পদ সঞ্চয়ই রাষ্ট্রের শক্তির প্রতীক হিসেবে গণ্য হতে থাকে।
  ফলত, মার্কেন্টাইলবাদ ইউরোপের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক বাণিজ্যনীতির রূপ নেয়।

---

🟩 মার্কেন্টাইলবাদের মূল তত্ত্ব :

১. রাষ্ট্রের সম্পদ মানে স্বর্ণ ও রৌপ্য।
২. রপ্তানি বৃদ্ধি ও আমদানি হ্রাস রাষ্ট্রের ধন বৃদ্ধি করে।
৩. বাণিজ্যের ভারসাম্য (Balance of Trade) রাষ্ট্রের পক্ষে রাখতে হবে।
৪. উপনিবেশ স্থাপন করে কাঁচামাল সংগ্রহ ও প্রস্তুত পণ্য বিক্রির বাজার তৈরি করতে হবে।
৫. রাষ্ট্র অর্থনীতিতে সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করবে।

---

🟩 মার্কেন্টাইলবাদের প্রকৃতি বা চরিত্র বিশ্লেষণ :

🔸 (ক) রাষ্ট্রকেন্দ্রিক অর্থনীতি :

মার্কেন্টাইল অর্থনীতি পুরোপুরি রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত।
রাষ্ট্র অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে দেশের ধনসম্পদ সঞ্চয় করত।

🔸 (খ) স্বর্ণ-রৌপ্য সঞ্চয়ের ওপর গুরুত্ব :

এই নীতির মূল ধারণা ছিল— ধনসম্পদ মানেই স্বর্ণ ও রৌপ্যের পরিমাণ।
তাই ইউরোপীয় দেশগুলো আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন করে ধাতব মুদ্রা আহরণে লিপ্ত হয়।

🔸 (গ) রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতি :

দেশের শিল্পপণ্য রপ্তানি করা এবং বিদেশি পণ্য আমদানি সীমিত রাখা ছিল রাষ্ট্রের প্রধান অর্থনৈতিক লক্ষ্য।
এভাবে দেশ থেকে ধন বাহিরে যাওয়া রোধ করা হতো।

🔸 (ঘ) উপনিবেশ ও একচেটিয়া বাণিজ্য :

উপনিবেশ থেকে সস্তা কাঁচামাল এনে নিজ দেশে শিল্পপণ্য তৈরি করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হতো।
রাষ্ট্র অনুমোদিত কোম্পানিগুলিকে (যেমন— ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার দেওয়া হতো।

🔸 (ঙ) রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ :

অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপ মার্কেন্টাইলবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
রাষ্ট্র কর, শুল্ক, মুদ্রা, বাণিজ্যনীতি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত।

🔸 (চ) কৃষি অবহেলা ও শিল্পের প্রাধান্য :

মার্কেন্টাইল চিন্তায় কৃষি উৎপাদনের চেয়ে শিল্প ও বাণিজ্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।
ফলে শহরভিত্তিক বণিক শ্রেণির উত্থান ঘটে।

🔸 (ছ) সামরিক শক্তির বিকাশ :

বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার জন্য নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনী শক্তিশালী করা হতো।
বাণিজ্য ও যুদ্ধ—দুটিই ছিল রাষ্ট্রের ধন সঞ্চয়ের উপায়।

---

🟩 মার্কেন্টাইলবাদের ফলাফল :

✅ ইতিবাচক ফলাফল :

• ইউরোপে জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তি গঠিত হয়।

• উপনিবেশ স্থাপন ও বৈশ্বিক বাণিজ্যের বিস্তার ঘটে।

• শিল্প বিপ্লবের পূর্বভূমি প্রস্তুত হয়।

• রাষ্ট্রের রাজস্ব বৃদ্ধি ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।

❌ নেতিবাচক ফলাফল :

• কৃষি ও সাধারণ জনগণের অবস্থার অবনতি ঘটে।

• উপনিবেশে শোষণ, দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্য বাড়ে।

• আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হয়।

• রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়।

---

🟩 মার্কেন্টাইলবাদের পতনের কারণ :

১৮শ শতাব্দীতে অ্যাডাম স্মিথ তাঁর “Wealth of Nations” (১৭৭৬) গ্রন্থে মার্কেন্টাইলবাদের তীব্র সমালোচনা করেন।
তিনি মুক্ত বাণিজ্য ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে বলেন—

“রাষ্ট্র নয়, বাজারের স্বাধীনতাই প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নতির চাবিকাঠি।”
ফলে মার্কেন্টাইলবাদ ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে পুঁজিবাদী মুক্ত অর্থনীতিতে রূপ নেয়।

---

🟩 উপসংহার :

মার্কেন্টাইলবাদ আধুনিক অর্থনৈতিক চিন্তার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
এটি ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ ও উপনিবেশ বিস্তারের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
যদিও এর শোষণমূলক দিক পরবর্তীকালে সমালোচিত হয়েছে, তবুও এই তত্ত্বই আধুনিক বিশ্ব অর্থনীতির কাঠামো গঠনের সূচনা করেছিল।

---

📝 ২. শিল্পবিপ্লব কথাটির অর্থ কী? শিল্পবিপ্লবের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।

---

🟩 ভূমিকা :

“শিল্পবিপ্লব” (Industrial Revolution) আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা।
এটি শুধু শিল্পক্ষেত্রে নয়, সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতেও গভীর পরিবর্তন এনেছিল।
১৮শ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইংল্যান্ডে শুরু হয়ে এই বিপ্লব ক্রমে সমগ্র ইউরোপ ও পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।

---

🟩 অর্থ বা সংজ্ঞা :

‘শিল্পবিপ্লব’ বলতে বোঝায়—

“মানুষের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় হঠাৎ এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন, যেখানে হস্তশিল্পের পরিবর্তে যন্ত্রশিল্পের প্রাধান্য স্থাপিত হয়।”

অর্থাৎ, হাতে কাজ থেকে মেশিনে কাজের পরিবর্তনই শিল্পবিপ্লবের মূল কথা।

অর্থনীতিবিদ আর্নল্ড টয়নবি বলেন—

“The Industrial Revolution was the substitution of machine power for human power.”

অর্থাৎ, মানুষের শক্তির পরিবর্তে যন্ত্রশক্তি ব্যবহারের নামই শিল্পবিপ্লব।

---

🟩 শিল্পবিপ্লবের সূচনা :

• ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ইংল্যান্ডে শুরু হয়।

• এর কেন্দ্রবিন্দু ছিল বস্ত্রশিল্প, লৌহশিল্প, কয়লা ও রেলপথ।

• পরবর্তীকালে এটি ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

---

🟩 শিল্পবিপ্লবের পটভূমি :

১. বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবন : ১৭শ ও ১৮শ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে সহায়ক হয়।
২. বাণিজ্য ও উপনিবেশ বিস্তার : বিদেশি উপনিবেশ থেকে কাঁচামাল ও বাজার পাওয়া সহজ হয়।
৩. কৃষিবিপ্লব : ইংল্যান্ডে কৃষিতে উন্নতির ফলে খাদ্য ও শ্রমিক উভয়ই সরবরাহ হয়।
৪. পুঁজির সঞ্চয় : বাণিজ্য থেকে সংগৃহীত বিপুল ধন শিল্পে বিনিয়োগ করা সম্ভব হয়।
৫. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা : ইংল্যান্ডের সংসদীয় গণতন্ত্র শিল্পোন্নয়নের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।

---

🟩 শিল্পবিপ্লবের বৈশিষ্ট্য :

🔸 (ক) হস্তশিল্পের পরিবর্তে যন্ত্রশিল্পের প্রবর্তন :

শিল্পবিপ্লবের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল হাতে তৈরি দ্রব্যের পরিবর্তে যন্ত্রের সাহায্যে বৃহৎ পরিমাণে পণ্য উৎপাদন।
‘স্পিনিং জেনি’, ‘স্টিম ইঞ্জিন’, ‘পাওয়ার লুম’ ইত্যাদি যন্ত্র এই বিপ্লবের প্রধান হাতিয়ার।

🔸 (খ) বাষ্পশক্তির ব্যবহার :

জেমস ওয়াট-এর বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কার শিল্পবিপ্লবের গতিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
বাষ্পশক্তি ব্যবহারে কারখানা, রেলগাড়ি, জাহাজ চলাচল সম্ভব হয়, ফলে পরিবহন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে।

🔸 (গ) কারখানা প্রথার বিকাশ :

ছোট ছোট কুটির শিল্পের পরিবর্তে বৃহৎ কারখানা গড়ে ওঠে।
একই ছাদের নিচে বহু শ্রমিক যন্ত্রের সাহায্যে উৎপাদনে অংশ নেন।
এই প্রথাই আধুনিক শিল্পসংগঠনের ভিত্তি স্থাপন করে।

🔸 (ঘ) নগরায়ণ :

কারখানার আশেপাশে শ্রমিকদের বসতি গড়ে ওঠে।
ফলে গ্রামীণ সমাজ ভেঙে নগরজীবনের উত্থান ঘটে।
লন্ডন, ম্যানচেস্টার, বার্মিংহ্যাম ইত্যাদি শহর দ্রুত বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়।

🔸 (ঙ) পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি :

রেলপথ, স্টিমার, খাল ও সড়ক নির্মাণ শিল্পপণ্যের দ্রুত পরিবহন নিশ্চিত করে।
এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত হয়।

🔸 (চ) শ্রমিক শ্রেণির উত্থান :

কারখানা প্রথার ফলে এক নতুন শ্রেণি— শ্রমিক শ্রেণি বা প্রলেতারিয়েত গঠিত হয়।
তারা শ্রমবিক্রয়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করে।

🔸 (ছ) পুঁজিপতি শ্রেণির উত্থান :

যন্ত্র, কাঁচামাল ও শ্রমিক ক্রয়ের জন্য বিপুল পুঁজি প্রয়োজন হয়।
ফলে পুঁজিপতি বা বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থান ঘটে, যারা শিল্প ও বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক হয়।

🔸 (জ) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার :

বেশি উৎপাদন হওয়ায় নতুন বাজারের প্রয়োজন দেখা দেয়।
এর ফলে ইউরোপীয় দেশগুলো উপনিবেশ স্থাপন করে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য সম্প্রসারিত করে।

🔸 (ঝ) সামাজিক পরিবর্তন :

গ্রামভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ভেঙে নতুন নগর সমাজ গড়ে ওঠে।
শ্রমিকদের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হলেও সমাজে শিক্ষা, বিজ্ঞান, রাজনীতি ও মানবাধিকারের প্রতি আগ্রহ বাড়ে।

🔸 (ঞ) রাজনৈতিক প্রভাব :

শিল্পবিপ্লব গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটায়।
শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে নতুন রাজনৈতিক শক্তির জন্ম হয়।

---

🟩 শিল্পবিপ্লবের ফলাফল :

✅ ইতিবাচক ফলাফল :

• উৎপাদন ও রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।

• মানুষের জীবনযাত্রায় যান্ত্রিক সুবিধা আসে।

• বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিক্ষার অগ্রগতি ঘটে।

• জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি এবং নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।

❌ নেতিবাচক ফলাফল :

• শ্রমিক শোষণ ও শিশুশ্রম বৃদ্ধি পায়।

• পরিবেশ দূষণ ও নগর দারিদ্র্যের বিস্তার ঘটে।

• অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শ্রেণিসংঘাত তীব্র হয়।

---

🟩 উপসংহার :

শিল্পবিপ্লব মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক মোড় পরিবর্তনের ঘটনা।
এটি শুধু উৎপাদন ব্যবস্থায় নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
যদিও এর ফলে শ্রমিকশ্রেণির দুর্দশা বেড়েছিল, তবু শিল্পবিপ্লবই আধুনিক যুগের প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক উন্নতির ভিত্তি স্থাপন করেছে।

---

📝 ৩. ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো।

---

🟩 ভূমিকা :

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের সমাজজীবন নানা কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, অস্পৃশ্যতা ও নারীনিগ্রহে আচ্ছন্ন ছিল।
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষিত বাঙালি সমাজে যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ ও আধুনিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটতে শুরু করে।
এই পরিবর্তনের ফলেই জন্ম নেয় ‘ধর্মসংস্কার আন্দোলন’, যা ভারতীয় সমাজে এক নবজাগরণের সূচনা করেছিল।

---

🟩 অর্থ বা সংজ্ঞা :

‘ধর্মসংস্কার আন্দোলন’ বলতে বোঝায়—

“১৮শ শতকের শেষ থেকে ১৯শ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে যে যুক্তিনির্ভর সংস্কারচেতনার উদ্ভব হয়েছিল, তাকে ধর্মসংস্কার আন্দোলন বলা হয়।”

এর মূল উদ্দেশ্য ছিল— হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ, কুসংস্কার দূরীকরণ ও সমাজে যুক্তিবাদী চেতনা প্রতিষ্ঠা।

---

🟩 ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পটভূমি বা কারণ :

🔸 (ক) ইংরেজ শাসন ও পাশ্চাত্য প্রভাব :

ব্রিটিশ শাসনের ফলে ইউরোপীয় শিক্ষা, বিজ্ঞান ও মানবিক মূল্যবোধ ভারতে প্রবেশ করে।
ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে ভারতীয়রা যুক্তিবাদ, স্বাধীনচিন্তা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয়।

🔸 (খ) খ্রিষ্টান মিশনারিদের কার্যকলাপ :

খ্রিষ্টান মিশনারিরা হিন্দুধর্মের কুসংস্কারকে আক্রমণ করে নিজেদের ধর্ম প্রচার করতে শুরু করে।
ফলে ভারতীয় শিক্ষিত সমাজ নিজের ধর্মকে যুক্তিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস নেয়।

🔸 (গ) সমাজের অবক্ষয় :

সতীদাহ, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, নারীশিক্ষার অভাব, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদি সমাজে গভীর অন্যায় তৈরি করেছিল।
এই অনাচার দূর করে সমাজে নতুন নৈতিক ভিত্তি স্থাপনের প্রয়োজন দেখা দেয়।

🔸 (ঘ) শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান :

ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত নবীন মধ্যবিত্ত শ্রেণি যুক্তিনির্ভর চিন্তা ও সমাজসেবায় উদ্বুদ্ধ হয়।
তাঁরাই ধর্মসংস্কার আন্দোলনের মূল বাহক হয়ে ওঠেন।

🔸 (ঙ) মুদ্রণযন্ত্র ও সংবাদপত্রের প্রসার :

সংবাদপত্র, সাময়িকী ও পুস্তকের মাধ্যমে নতুন চিন্তাধারা সহজে প্রচারিত হতে থাকে।
এর ফলে সমাজে সংস্কারের বার্তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

---

🟩 প্রধান ধর্মসংস্কার আন্দোলন ও ব্যক্তিত্ব :

🔸 (১) ব্রাহ্মসমাজ (১৮২৮)

প্রতিষ্ঠাতা : রাজা রামমোহন রায়
উদ্দেশ্য : একেশ্বরবাদ প্রচার, সতীদাহ ও কুসংস্কারের বিলোপ, নারীশিক্ষা প্রচার।
ফলাফল : সতীদাহ প্রথা বন্ধ (১৮২৯), নারীজাগরণ ও আধুনিক যুক্তিবাদী চিন্তার সূচনা।

🔸 (২) তত্ত্ববোধিনী সভা (১৮৩৯)

প্রতিষ্ঠাতা : দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
উদ্দেশ্য : উপনিষদীয় একেশ্বরবাদ প্রচার, নৈতিক শিক্ষা, আত্মশুদ্ধি।
ফলাফল : ব্রাহ্মধর্মের নতুন দার্শনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা।

🔸 (৩) ব্রাহ্মসমাজের নবজাগরণ (১৮৬৬)

নেতা : কেশবচন্দ্র সেন
উদ্দেশ্য : সামাজিক সংস্কার, নারীশিক্ষা, মদ্যনিষেধ, জাতিভেদের বিলোপ।
ফলাফল : ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’ গঠনের মাধ্যমে ধর্মীয় উদারতার বিস্তার।

🔸 (৪) আর্য সমাজ (১৮৭৫)

প্রতিষ্ঠাতা : স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী
উদ্দেশ্য : বেদে প্রত্যাবর্তন, জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার বিরোধিতা।
ফলাফল : ‘শুদ্ধি আন্দোলন’-এর মাধ্যমে হিন্দুধর্মে ঐক্যবোধের পুনর্জাগরণ।

🔸 (৫) রামকৃষ্ণ মিশন (১৮৯৭)

প্রতিষ্ঠাতা : স্বামী বিবেকানন্দ
উদ্দেশ্য : সেবা ও ধর্মের সমন্বয়— “জীব সেবাই শিব সেবা”।
ফলাফল : জাতীয়তাবাদ ও মানবকল্যাণমূলক কর্মধারার বিকাশ।

🔸 (৬) থিওসফিক্যাল সোসাইটি

নেতা : মাদাম ব্লাভাতস্কি ও অ্যানি বেসান্ত
উদ্দেশ্য : ভারতীয় ধর্ম ও দর্শনের মাহাত্ম্য প্রচার, নারীমুক্তি ও শিক্ষার প্রসার।
ফলাফল : জাতীয়তাবাদী চেতনা ও নারীজাগরণের শক্তি বৃদ্ধি।

---

🟩 ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলাফল :

✅ (১) সামাজিক সংস্কার :

সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতি কুপ্রথার বিলোপ ঘটে।
নারীশিক্ষা ও বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের মাধ্যমে সমাজে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা পায়।

✅ (২) ধর্মীয় পুনর্জাগরণ :

হিন্দুধর্মে একেশ্বরবাদ ও যুক্তিনির্ভর বিশ্বাসের বিকাশ ঘটে।
ধর্মে উদারতা ও মানবপ্রেমের ধারা শক্তিশালী হয়।

✅ (৩) শিক্ষা ও যুক্তিবাদ :

ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্য দর্শনের প্রভাবে যুক্তিবাদী মনোভাব তৈরি হয়।
মানুষ কুসংস্কার থেকে মুক্তি পেতে চায়।

✅ (৪) জাতীয়তাবাদের উত্থান :

রামমোহন, বিবেকানন্দ প্রমুখের চিন্তা জাতীয় গৌরববোধ জাগিয়ে তোলে।
এর ফলেই ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি গঠিত হয়।

✅ (৫) নারীজাগরণ :

নারীর শিক্ষা, সামাজিক অধিকার ও স্বনির্ভরতার প্রচার ঘটে।
সারোজিনী নাইডু, পন্ডিতা রমাবাই প্রমুখ এই ধারা থেকে অনুপ্রাণিত হন।

---

🟩 উপসংহার :

ধর্মসংস্কার আন্দোলন ছিল ভারতের নবজাগরণের প্রথম অধ্যায়।
এটি সমাজে যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ ও আধুনিক চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিল।
এই আন্দোলনের ফলে ভারতীয় সমাজ কুসংস্কারমুক্ত, উদার ও প্রগতিশীল পথে অগ্রসর হতে শুরু করে।
অতএব, ধর্মসংস্কার আন্দোলনই আধুনিক ভারতের চিন্তাচেতনা ও জাতীয় পুনর্জাগরণের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

---

📝 ৪. মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে জার্মানিতে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পরিচয় দাও।

---

🟩 ভূমিকা :

১৬শ শতকে ইউরোপের খ্রিষ্টান সমাজের ধর্মজীবন গভীরভাবে অবক্ষয়গ্রস্ত হয়ে পড়ে।
পোপ ও যাজকবর্গের ভোগবিলাস, দুর্নীতি, এবং ‘পাপ মোচনের টিকিট’ বিক্রির মতো অনাচারের ফলে খ্রিষ্টধর্ম তার মৌলিক নৈতিকতা হারিয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে জার্মান ধর্মগুরু মার্টিন লুথার এক সাহসী আন্দোলনের সূচনা করেন, যা ইতিহাসে পরিচিত ‘প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মসংস্কার আন্দোলন’ (Protestant Reformation) নামে।

---

🟩 ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট :

🔸 (১) চার্চের অবক্ষয় :

রোমান ক্যাথলিক চার্চ ধর্মের নাম করে অর্থলোভে ডুবে যায়।
যাজকরা জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হয়।
ধর্মীয় নেতারা ঈশ্বরসেবা নয়, সম্পদ ও রাজনীতির প্রভাব বিস্তারে মনোনিবেশ করেন।

🔸 (২) পোপদের দুর্নীতি :

পোপদের অধঃপতন ও ভোগবিলাস জনমনে ঘৃণা সৃষ্টি করে।
তাঁরা “Indulgence” বা ‘পাপমোচনের দলিল’ বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করত, যাতে মানুষ টাকা দিয়ে পাপ মোচন করতে পারত।

🔸 (৩) মানবতাবাদ ও নবজাগরণের প্রভাব :

রেনেসাঁ বা নবজাগরণের যুগে যুক্তিবাদ ও স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটে।
মানুষ আর অন্ধভাবে চার্চের কথা মেনে নিতে রাজি ছিল না।

🔸 (৪) রাজনৈতিক কারণ :

জার্মান রাজারা পোপের ক্ষমতা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
তাঁরা জাতীয় স্বার্থে চার্চবিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করেন।

🔸 (৫) অর্থনৈতিক কারণ :

চার্চ বিপুল পরিমাণ জমি ও সম্পদের মালিক ছিল।
পোপ রোমে কর আদায় করতেন, যা জার্মান রাজ্যগুলির ক্ষোভের কারণ হয়।

---

🟩 মার্টিন লুথারের ভূমিকা :

🔸 (১) সংক্ষিপ্ত পরিচয় :

মার্টিন লুথার (Martin Luther) জন্মগ্রহণ করেন ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির আইসলেবেনে।
তিনি একজন সন্ন্যাসী ও ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক ছিলেন।
চার্চের দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি ধর্মের সত্য ব্যাখ্যা মানুষের সামনে তুলে ধরেন।

🔸 (২) ৯৫ দফা অভিযোগ (Ninety-Five Theses):

১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে লুথার উইটেনবার্গ গির্জার দরজায় তাঁর ৯৫ দফা অভিযোগপত্র টাঙিয়ে দেন।
এর মাধ্যমে তিনি পাপমোচনের দলিল বিক্রির বিরোধিতা করে ঘোষণা করেন যে,

“মানুষের পাপ ক্ষমা হয় ঈশ্বরের করুণা ও বিশ্বাসে, টাকায় নয়।”

এই ঘটনাই জার্মান ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা করে।

🔸 (৩) লুথারের ধর্মতত্ত্ব :

তিনি বলেন—

• বাইবেলই ধর্মের একমাত্র ভিত্তি (Sola Scriptura)।

• ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসেই মানুষ মুক্তি পেতে পারে (Justification by Faith)।

• পুরোহিতদের মধ্যস্থতা প্রয়োজন নয়— ঈশ্বর ও মানুষের সম্পর্ক সরাসরি।

• চার্চের আচার ও আনুষ্ঠানিকতা নয়, ধর্মের মূল উদ্দেশ্য মানবমুক্তি।

🔸 (৪) লুথারের বিরুদ্ধে পোপের প্রতিক্রিয়া :

পোপ তাঁকে ধর্মচ্যুত ঘোষণা করেন এবং গ্রেফতারের নির্দেশ দেন।
কিন্তু স্যাক্সনি রাজা ফ্রেডেরিক তাঁকে আশ্রয় দেন।
এই সময় লুথার বাইবেল জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন, যাতে সাধারণ মানুষও তা পড়তে পারে।

🔸 (৫) প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের জন্ম :

লুথারের অনুসারীরা পোপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ (Protest) জানিয়ে নতুন ধর্মীয় সম্প্রদায় গঠন করেন—
এটাই ‘প্রোটেস্ট্যান্ট’ (Protestant) নামে পরিচিত।
এর ফলে ইউরোপে খ্রিষ্টধর্ম বিভক্ত হয়—
ক্যাথলিক (Catholic) ও প্রোটেস্ট্যান্ট (Protestant) দুটি শাখায়।

---

🟩 ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলাফল :

✅ (১) ধর্মীয় প্রভাব :

চার্চের একচ্ছত্র আধিপত্য ভেঙে যায়।
প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক— এই দুই ধারার মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণা জন্ম নেয়।

✅ (২) সামাজিক প্রভাব :

মানুষ অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্তি পায় এবং শিক্ষা ও নৈতিকতার দিকে মনোযোগ দেয়।
জনগণের মধ্যে ধর্মীয় সহনশীলতা ও ব্যক্তিগত চিন্তার মূল্য বৃদ্ধি পায়।

✅ (৩) রাজনৈতিক প্রভাব :

জাতীয় রাজারা পোপের কর্তৃত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে নিজস্ব রাষ্ট্রক্ষমতা সুদৃঢ় করেন।
জার্মানিতে একধরনের রাজনৈতিক ঐক্যের বীজ রোপিত হয়।

✅ (৪) সাংস্কৃতিক প্রভাব :

বাইবেল স্থানীয় ভাষায় অনুবাদের ফলে সাহিত্য ও ভাষার উন্নতি ঘটে।
মুদ্রণযন্ত্রের মাধ্যমে ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

✅ (৫) শিক্ষাগত প্রভাব :

প্রোটেস্ট্যান্টরা বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
শিক্ষা সাধারণ মানুষের নাগালে পৌঁছে যায়।

✅ (৬) অর্থনৈতিক প্রভাব :

পোপের অর্থনৈতিক কর আরোপ বন্ধ হওয়ায় জাতীয় অর্থনীতি উন্নতি লাভ করে।
শ্রম, সততা ও আত্মনির্ভরতার আদর্শ গড়ে ওঠে— যা পরবর্তীকালে ‘পুঁজিবাদের বিকাশে’ ভূমিকা রাখে।

---

🟩 উপসংহার :

মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে জার্মানির ধর্মসংস্কার আন্দোলন ছিল ইউরোপীয় সমাজের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক।
এটি শুধু ধর্মীয় পরিবর্তনই নয়, বরং সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির সূচনা ঘটায়।
লুথার মানুষের স্বাধীনচিন্তা ও আত্মসম্মানের বোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন।
তাঁর আন্দোলন ইউরোপে আধুনিক যুগের দরজা খুলে দেয়,
এবং মানবসভ্যতাকে নতুন দিশা দেখায়— “ধর্মের মূল সত্য নিহিত আছে মানুষের বিশ্বাস ও নৈতিকতার মধ্যেই।”

---

📝 ৫. জাতীয় রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দাও। জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থানের পিছনে তত্ত্বগত প্রেরণা কী ছিল?

---

🟩 ভূমিকা :

ইউরোপে মধ্যযুগের পর যখন সামন্ততন্ত্র ও চার্চের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন মানুষের রাজনৈতিক চেতনা নতুন পথে বিকশিত হয়।
মানুষ বুঝতে শেখে— ধর্ম, বংশ বা ব্যক্তিগত আনুগত্য নয়; বরং একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি ও এক প্রশাসনের অধীনে সংগঠিত জনগোষ্ঠীই একটি জাতি।
এই ধারণার বাস্তব রূপই জাতীয় রাষ্ট্র (Nation-State)।
জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নির্দেশ করে।

---

🟩 জাতীয় রাষ্ট্রের সংজ্ঞা :

🔸 (১) সাধারণ অর্থে :

জাতীয় রাষ্ট্র হলো এমন এক রাজনৈতিক সংগঠন, যেখানে রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী একই ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জাতীয় চেতনায় ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং একটি সার্বভৌম কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়।

🔸 (২) বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা :

রাজনৈতিক চিন্তাবিদ এর্নেস্ট রেনান (Ernest Renan) বলেন—

“Nation is a soul, a spiritual principle; it is the desire to live together.”
অর্থাৎ জাতি শুধু রক্তের বন্ধন নয়, বরং একটি মানসিক ঐক্য ও সম্মিলিত ইচ্ছার প্রকাশ।

🔸 (৩) মূল বৈশিষ্ট্য :

জাতীয় রাষ্ট্রে চারটি উপাদান থাকে —

• নির্দিষ্ট ভূখণ্ড

• ঐক্যবদ্ধ জনগোষ্ঠী

• সার্বভৌম সরকার

• জাতীয় চেতনা বা দেশপ্রেম

এই চারটি উপাদান মিলে গঠিত রাষ্ট্রই প্রকৃত অর্থে “জাতীয় রাষ্ট্র”।

---

🟩 জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থানের পটভূমি :

জাতীয় রাষ্ট্র হঠাৎ করে গঠিত হয়নি। এর পেছনে মধ্যযুগের দীর্ঘ রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও বৌদ্ধিক পরিবর্তন কাজ করেছে।

🔹 (১) সামন্ততন্ত্রের পতন :

মধ্যযুগে ইউরোপে রাজশক্তি দুর্বল ছিল, জমিদার বা লর্ডদের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা ছিল।
ধীরে ধীরে বাণিজ্য ও শহর জীবনের বিকাশের ফলে সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটে এবং রাজারা কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগী হন।

🔹 (২) বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন :

মধ্যযুগের শেষে বাণিজ্য, ব্যাংকিং, শিল্প ও পুঁজির প্রসার ঘটে।
এই অর্থনৈতিক উন্নতি এক অভিন্ন বাজার ও প্রশাসনিক একতার প্রয়োজন সৃষ্টি করে— যা জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণাকে শক্তিশালী করে।

🔹 (৩) ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন (Reformation):

মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে ধর্মসংস্কার আন্দোলন পোপের কর্তৃত্ব ভেঙে দেয়।
চার্চের পরিবর্তে রাজারা নিজেদের রাষ্ট্রে স্বাধীন ধর্ম ও শাসনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।
এর ফলে রাজশক্তির উত্থান ও জাতীয় ঐক্যের বোধ গঠিত হয়।

🔹 (৪) নবজাগরণ (Renaissance):

নবজাগরণের মানবতাবাদ মানুষকে আত্মচেতনা ও স্বাধীন চিন্তার শিক্ষা দেয়।
মানুষ নিজেকে ধর্ম বা বংশের প্রতিনিধি নয়, বরং একটি জাতির নাগরিক হিসেবে চিনতে শুরু করে।

🔹 (৫) মুদ্রণযন্ত্র ও ভাষার বিকাশ :

মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কারে স্থানীয় ভাষায় বই প্রকাশ পায়।
এর ফলে সাধারণ মানুষ তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে, যা জাতীয়তাবাদের ভিত্তি তৈরি করে।

🔹 (৬) সামরিক বিপ্লব ও রাজশক্তি :

রাজাদের স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠনের ফলে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
এতে স্থানীয় প্রভুদের ক্ষমতা কমে এবং রাষ্ট্র একীভূত হতে থাকে।

---

🟩 জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থানের তত্ত্বগত প্রেরণা :

জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা কেবল রাজনৈতিক বাস্তবতা নয়; এর পিছনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব কাজ করেছে।

🔸 (১) প্রাকৃতিক অধিকার তত্ত্ব (Natural Rights Theory):

জন লক ও রুশোর মতে— প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন ও সমান।
রাষ্ট্র গঠনের মূল উদ্দেশ্য মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষা করা।
এই চিন্তাধারাই জাতীয় রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ভিত্তি স্থাপন করে।

🔸 (২) সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব (Social Contract Theory):

থমাস হবস, লক ও রুশো বলেন—
মানুষ নিজেদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করেছে।
এই তত্ত্ব মানুষকে শাসকের কাছে নয়, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য শেখায়।

🔸 (৩) জাতীয়তাবাদ তত্ত্ব (Theory of Nationalism):

হেরডার, ফিখতে, মাজিনি প্রমুখ চিন্তাবিদ বলেন—
এক ভাষা, এক সংস্কৃতি ও এক ঐতিহ্যের মানুষই একটি জাতি গঠন করে।
তাঁদের মতে, “জাতীয় চেতনা হলো রাজনৈতিক স্বাধীনতার আত্মা।”

🔸 (৪) সার্বভৌম রাষ্ট্র তত্ত্ব (Theory of Sovereignty):

জ্যাঁ বোদিন (Jean Bodin) বলেন—
রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা কোনো বাহ্যিক শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না।
এই ধারণা জাতীয় রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার মূল ভিত্তি স্থাপন করে।

---

🟩 জাতীয় রাষ্ট্রের উদাহরণ ও বিকাশ :

১৫শ শতকে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও স্পেন— এই তিনটি দেশে জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান দেখা যায়।
রাজারা চার্চের ক্ষমতা দমন করে কেন্দ্রীভূত প্রশাসন গঠন করেন।
পরবর্তীকালে ইতালি ও জার্মানি ১৯শ শতকে জাতীয় ঐক্যের জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম চালিয়ে একীভূত রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

---

🟩 জাতীয় রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য :

• শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার

• অভিন্ন আইন ও প্রশাসন

• জনগণের মধ্যে জাতীয় চেতনা ও দেশপ্রেম

• রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব

• ভাষা ও সংস্কৃতির ঐক্য

---

🟩 উপসংহার :

জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান ইউরোপের ইতিহাসে আধুনিক যুগের সূচক।
এটি সামন্ততন্ত্র, চার্চ ও সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল ভেঙে “জনগণের রাষ্ট্র” গঠনের সূচনা করে।
জাতীয় রাষ্ট্র মানুষের স্বাধীনতা, সমতা ও ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠে।
আজকের বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রই জাতীয় রাষ্ট্রের ধারাবাহিক রূপ —
যেখানে রাষ্ট্রের শক্তি নিহিত জনগণের ঐক্য ও জাতীয় চেতনার মধ্যে।

---

📝 ৬. স্পেনে চরম রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কারণগুলি লেখো। রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ইসাবেলা ও ফার্দিনান্দের লক্ষ্য কী ছিল?

✅ উত্তর:

চরম রাজতন্ত্রের ধারণা:
চরম রাজতন্ত্র (Absolute Monarchy) এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে রাজা বা রানী সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। তাঁর সিদ্ধান্তের উপর কোনো সংসদ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা অভিজাত শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ইউরোপে মধ্যযুগের পর রাজকীয় ক্ষমতা পুনর্গঠনের প্রয়োজনে এই ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, আর স্পেনে তা বিশেষভাবে দৃশ্যমান হয় ইসাবেলা ও ফার্দিনান্দের যুগে।

স্পেনে চরম রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কারণসমূহ:

(১) রিকনকুয়িস্টার সমাপ্তি:
স্পেনে দীর্ঘদিন ধরে খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের মধ্যে সংঘাত চলেছিল। গ্রানাডা বিজয়ের (১৪৯২) মাধ্যমে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে, যা খ্রিষ্টান ঐক্য ও রাজকীয় ক্ষমতার পুনরুজ্জীবনে সহায়তা করে।

(২) ইসাবেলা ও ফার্দিনান্দের বিবাহ:
কাস্টিলের ইসাবেলা ও আরাগনের ফার্দিনান্দের বিবাহ (১৪৬৯) স্পেনের দুই প্রধান রাজ্যকে একীভূত করে। এই রাজনৈতিক ঐক্য ছিল স্পেনে কেন্দ্রীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মূলভিত্তি।

(৩) চার্চের সমর্থন:
ইসাবেলা ও ফার্দিনান্দ পোপের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ইনকুইজিশন চালু করেন, যার মাধ্যমে ধর্মবিরোধী বা মুসলিম ও ইহুদি প্রভাবকে দমন করা হয়। ফলে চার্চ ও রাজতন্ত্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা রাজক্ষমতা সুদৃঢ় করে।

(৪) অভিজাতদের শক্তি দমন:
মধ্যযুগে অভিজাত শ্রেণি (nobles) রাজশক্তিকে দুর্বল করেছিল। ইসাবেলা ও ফার্দিনান্দ তাঁদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তারা “Santa Hermandad” নামের জনসাধারণের নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করেন, যা রাজকীয় কর্তৃত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে।

(৫) প্রশাসনিক ও আর্থিক সংস্কার:
রাজা ও রাণী তাঁদের রাজকোষ সুসংগঠিত করেন। ট্যাক্স ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয় এবং কেন্দ্রীয় রাজস্ব বিভাগের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে বিচারব্যবস্থাও রাজকীয় নিয়ন্ত্রণে আনা হয়, ফলে স্থানীয় ক্ষমতাধরদের কর্তৃত্ব হ্রাস পায়।

(৬) নৌবাণিজ্য ও আবিষ্কার অভিযানের প্রসার:
ইসাবেলা ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে অর্থ সহায়তা দিয়ে নতুন বিশ্বের আবিষ্কার (১৪৯২) সম্ভব করেন। এতে স্পেন বিপুল সম্পদ লাভ করে এবং রাজকীয় ধনভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়, যা রাজশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক ছিল।

(৭) ধর্মীয় ঐক্যের প্রচেষ্টা:
ইহুদি ও মুসলমানদের ধর্মান্তর বা বহিষ্কারের মাধ্যমে তারা জাতীয় ঐক্য ও ধর্মীয় শুদ্ধতা বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। “এক রাজা, এক ধর্ম, এক আইন”—এই মূলনীতি তাঁদের শাসননীতির ভিত্তি ছিল।

(৮) সামরিক ক্ষমতার বৃদ্ধি:
তাঁরা স্থায়ী সৈন্যবাহিনী গঠন করেন, যা রাজাকে স্বাধীনভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়। এ বাহিনী রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করে তোলে।

ইসাবেলা ও ফার্দিনান্দের লক্ষ্য:
ইসাবেলা ও ফার্দিনান্দের প্রধান লক্ষ্য ছিল স্পেনে একক ও শক্তিশালী জাতীয় রাজতন্ত্র গঠন করা। তাঁরা অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা দমন, ধর্মীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি করে রাজশক্তিকে জনগণের উপরে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের রাজনীতি ছিল "Monarchy above all" নীতিতে বিশ্বাসী।

উপসংহার:
ইসাবেলা ও ফার্দিনান্দের যুগে স্পেন এক শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তাঁদের হাতে স্পেন শুধু চরম রাজতন্ত্রের মডেলই তৈরি করেনি, বরং ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করে। তাঁদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, ধর্মীয় কৌশল এবং প্রশাসনিক দক্ষতা স্পেনে “Catholic Monarchy”-এর ভিত্তি স্থাপন করে, যা পরবর্তী শতাব্দীতে ইউরোপের রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

📝 ৭. সামন্ত অর্থনীতি থেকে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে রূপান্তরের বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণগুলি আলোচনা করো।

✅ উত্তর:

ভূমিকা:
মধ্যযুগীয় ইউরোপে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান ভিত্তি ছিল সামন্ততন্ত্র (Feudalism), যেখানে জমি ছিল উৎপাদনের মূল উপাদান এবং কৃষক শ্রেণি ছিল জমিদারের অধীন। কিন্তু ১৫শ শতাব্দীর পর থেকে ধীরে ধীরে এই সামন্ত অর্থনীতি ভেঙে পড়ে এবং তার জায়গায় জন্ম নেয় পুঁজিবাদী অর্থনীতি (Capitalism), যার মূল ভিত্তি ছিল বাণিজ্য, শিল্প এবং ব্যক্তিগত মালিকানা। এই রূপান্তর কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়—বরং এটি এক দীর্ঘ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফল।

---

প্রথমত — কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তন:
মধ্যযুগে কৃষিজ উৎপাদন নির্ভর করত জমিদারের জমিতে কৃষকের শ্রমের উপর। কিন্তু কৃষি প্রযুক্তির উন্নতি এবং চাষের নতুন পদ্ধতি—যেমন তিনফসলি ব্যবস্থা ও নতুন কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার—উৎপাদন বাড়ায়। কৃষকরা ধীরে ধীরে জমির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে স্বাধীনভাবে পণ্য উৎপাদন শুরু করে। এই পরিবর্তন বাজারভিত্তিক কৃষি অর্থনীতির সূচনা ঘটায়, যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করে।

---

দ্বিতীয়ত — বাণিজ্য বিপ্লব (Commercial Revolution):
১৫শ শতাব্দী থেকে ইউরোপে দূরপাল্লার বাণিজ্যের বিস্তার ঘটে। এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়, ফলে বিপুল পুঁজি জমা হতে থাকে। সোনা-রূপার প্রবাহ, নতুন বাণিজ্যপথের আবিষ্কার, ও উপনিবেশ স্থাপন—সবকিছু মিলিয়ে ইউরোপের বণিক শ্রেণি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই শ্রেণিই পরবর্তীকালে শিল্পবিপ্লব ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি হয়ে ওঠে।

---

তৃতীয়ত — শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্রের উত্থান:
মধ্যযুগে নগরজীবন সীমিত ছিল। কিন্তু বাণিজ্য বৃদ্ধির ফলে নতুন শহর ও বন্দর গড়ে ওঠে—যেমন ভেনিস, ফ্লোরেন্স, আমস্টারডাম, লন্ডন প্রভৃতি। এই শহরগুলিতে গিল্ড বা ব্যবসায়ী সংঘ গঠিত হয়, যা পণ্যের উৎপাদন, মূল্য নির্ধারণ ও বাণিজ্যের নীতি নিয়ন্ত্রণ করত। নগরজীবনের বিকাশ সমাজে নতুন বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থান ঘটায়, যারা পুঁজিবাদী চিন্তার বাহক ছিল।

---

চতুর্থত — সামন্ত প্রভুদের শক্তি হ্রাস:
রাজাদের হাতে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি ও রাষ্ট্রের ঐক্য প্রতিষ্ঠার ফলে স্থানীয় সামন্ত প্রভুরা তাঁদের পুরনো ক্ষমতা হারাতে থাকে। রাজারা একক প্রশাসনিক ও করব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ফলত, রাজনৈতিকভাবে একীভূত রাষ্ট্রে বাণিজ্য ও শিল্পের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতি সামন্ত অর্থনীতির পতন ত্বরান্বিত করে।

---

পঞ্চমত — মজুরি শ্রমের উদ্ভব:
সামন্ততন্ত্রে কৃষকরা ছিলেন জমির সঙ্গে বাঁধা। কিন্তু জমি-বিন্যাসের পরিবর্তন (Enclosure Movement) এর ফলে বহু কৃষক জমি হারিয়ে শহরে চলে আসেন। তাঁরা শ্রম বিক্রি করে জীবিকা অর্জন শুরু করেন। ফলে শ্রমিক শ্রেণির জন্ম হয়, যা শিল্প পুঁজিবাদের অপরিহার্য উপাদান।

---

ষষ্ঠত — শিল্প ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন:
হস্তশিল্প থেকে যান্ত্রিক শিল্পে রূপান্তর ঘটে। প্রথমে বস্ত্রশিল্প, পরে লোহা, কয়লা ও জাহাজ নির্মাণ শিল্প বিকশিত হয়। এই পরিবর্তন উৎপাদনশীলতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় এবং মূলধন সঞ্চয় বাড়াতে সাহায্য করে। শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে।

---

সপ্তমত — নতুন চিন্তাধারা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার বিকাশ:
পুনর্জাগরণ (Renaissance) ও ধর্মসংস্কার আন্দোলন (Reformation) ব্যক্তিস্বাধীনতা ও যুক্তিবাদী চিন্তাকে উৎসাহ দেয়। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ব্যক্তিগত পরিশ্রম ও মেধাই সম্পদের উৎস। এই দৃষ্টিভঙ্গি পুঁজিবাদী অর্থনীতির আদর্শিক ভিত্তি রচনা করে।

---

অষ্টমত — বৈদেশিক উপনিবেশ স্থাপন:
ইউরোপীয় শক্তিগুলি (বিশেষত স্পেন, পর্তুগাল, ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ড) আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে। এই উপনিবেশগুলি থেকে তারা সোনা, রূপা, চিনি, তুলা ইত্যাদি বিপুল সম্পদ আহরণ করে। এ সম্পদ ইউরোপীয় পুঁজির ভিত্তি মজবুত করে।

---

নবমত — ব্যাংকিং ও আর্থিক ব্যবস্থার উন্নতি:
ব্যাংক, শেয়ারবাজার ও বীমা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যেমন Bank of Amsterdam ও Bank of England। এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি বিনিয়োগ ও পুঁজির প্রবাহকে সংগঠিত করে, যা বাণিজ্যিক ও শিল্প উদ্যোগকে উৎসাহিত করে।

---

উপসংহার:
সুতরাং দেখা যায়, সামন্ত অর্থনীতি থেকে পুঁজিবাদে রূপান্তর ছিল এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, যার সঙ্গে যুক্ত ছিল কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, রাজনীতি ও চিন্তাধারার মৌলিক পরিবর্তন। এই রূপান্তর ইউরোপের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করে—যেখানে মানুষ ও মুনাফাই অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান পায়। পুঁজিবাদের উত্থান শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরেরও প্রতীক হয়ে ওঠে।

<<<<<<<<<<<<<<<<🌹সমাপ্ত🌹>>>>>>>>>>> 

👉For pdf whatsapp-8250978714