🌹বি.এ সেমিষ্টার-৪::মেজর ইতিহাস(পেপার-১)সাজেশন(PART-3)🌹

✍️প্রশ্নের মান-১০:

📝 ১. কৈবর্ত বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো।

উত্তর :
কৈবর্ত বিদ্রোহ বাংলার মধ্যযুগের এক গুরুত্বপূর্ণ জনআন্দোলন। এটি শুধু রাজদণ্ডবিরোধী বিদ্রোহই নয়, বরং শ্রেণি ও সমাজবিরোধী আন্দোলন হিসেবেও ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। পলাশীর যুদ্ধের বহু শতাব্দী আগে সংঘটিত এই বিদ্রোহ বাংলার সমাজে ন্যায়বিচার ও অধিকারচেতনার এক শক্তিশালী প্রতীক।

---

⚫ বিদ্রোহের পটভূমি :

কৈবর্ত বিদ্রোহ সংঘটিত হয় পাল রাজা মহীপালের (১০৭০–১০৭৫ খ্রিষ্টাব্দ) আমলে। তৎকালীন বাংলায় পাল শাসনের শেষ পর্যায়ে প্রশাসনিক দুর্বলতা, সামন্তদের আত্মকেন্দ্রিকতা ও কৃষকদের উপর অত্যাচার চরমে উঠেছিল। এরই মধ্যে বরেন্দ্রভূমি অঞ্চলের (বর্তমান রাজশাহী জেলা) কৈবর্ত সম্প্রদায়, যারা ছিল মূলত জেলে ও কৃষক, তারা বিদ্রোহে ফেটে পড়ে।

---

⚫ বিদ্রোহের কারণ :

১. অর্থনৈতিক শোষণ :
পাল আমলে জমিদার ও রাজকর্মচারীরা কৃষকদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করত। কৈবর্তরা ছিল দরিদ্র কৃষিজীবী মানুষ। তাদের থেকে অসহনীয় খাজনা আদায়, জোরপূর্বক শ্রমদায়িত্ব ও লুণ্ঠনের ফলে জনঅসন্তোষ বৃদ্ধি পায়।

২. প্রশাসনিক অব্যবস্থা :
রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ায় স্থানীয় সামন্ত, ভূস্বামী ও কর আদায়কারীরা নিজেদের মতো শাসন চালাতে থাকে। এতে সাধারণ মানুষের উপর অন্যায় অত্যাচার ও দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়।

৩. সামাজিক বৈষম্য :
কৈবর্তরা জাতিগতভাবে নিম্নবর্গীয় বলে ব্রাহ্মণ্য ও রাজন্যশ্রেণির দ্বারা চিরকাল অবহেলিত ছিল। তারা সমাজে মর্যাদা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। এই দীর্ঘস্থায়ী বৈষম্য বিদ্রোহের মনোভাব জাগিয়ে তোলে।

৪. জাতীয়তাবোধ ও ন্যায়চেতনা :
কৈবর্ত নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন, রাজশক্তির দুর্বলতার সুযোগে জনগণের স্বার্থ রক্ষার একমাত্র পথ বিদ্রোহ। ‘মত্সন্যায়’—অর্থাৎ বড় মাছ ছোট মাছকে খায়—এই অন্যায় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদে উঠে দাঁড়ায়।

---

⚫ বিদ্রোহের সূচনা ও বিস্তার :

কৈবর্ত নেতা দিব্যক (Divya বা Divyok) ছিলেন এই বিদ্রোহের মূল সূচক। তিনি ছিলেন এক প্রভাবশালী স্থানীয় প্রধান। প্রথমে তিনি বরেন্দ্রভূমিতে পাল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালান। দিব্যক মহীপালকে পরাজিত করে বরেন্দ্র অঞ্চল দখল করেন এবং স্বতন্ত্র শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

দিব্যকের পর তাঁর ভাই রুদ্রক ও পুত্র ভীম রাজত্ব করেন। তাঁরা প্রায় এক দশক ধরে বরেন্দ্রভূমি স্বাধীনভাবে শাসন করেন। তাঁদের শাসনে কৃষক ও শ্রমজীবী জনগণ কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

---

⚫ বিদ্রোহ দমন :

পাল রাজা রমাপাল (মহীপালের উত্তরসূরি) পরবর্তীকালে কৈবর্তদের বিরুদ্ধে বৃহৎ অভিযান পরিচালনা করেন। তাঁর সেনাপতি সন্দেহ ও ভীম সেন-এর নেতৃত্বে পালবাহিনী বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রবল যুদ্ধ চালায়। অবশেষে রমাপাল ভীমকে হত্যা করে বিদ্রোহ দমন করেন।

---

⚫ বিদ্রোহের ফলাফল :

১. রাজশক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা :
রমাপাল বিদ্রোহ দমন করে বরেন্দ্র অঞ্চলে পুনরায় পাল শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর রাজত্বে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা কিছুটা ফিরিয়ে আনা হয়।

২. পাল শাসনের দুর্বলতা প্রকাশ :
যদিও রমাপাল বিদ্রোহ দমন করেন, তবে এই বিদ্রোহে পাল শাসনের ভিত নড়ে যায়। জনগণের মধ্যে রাজাদের প্রতি আনুগত্য কমে যায়। শাসনের কেন্দ্রাভিমুখ শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।

৩. সামাজিক পরিবর্তন :
কৈবর্ত বিদ্রোহ সমাজে নিম্নবর্গের আত্মচেতনা ও ন্যায়বোধ জাগিয়ে তোলে। এটি ছিল বাংলায় শ্রেণি-সংগ্রামের প্রাথমিক রূপ।

৪. রাজনৈতিক প্রভাব :
এই বিদ্রোহের ফলে উত্তরবঙ্গের অনেক অংশ স্বাধীনভাবে কিছুদিন শাসিত হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে পাল রাজ্যের ভাঙনের কারণ হয়। পাল সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে সেন রাজবংশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

---

⚫ উপসংহার :

কৈবর্ত বিদ্রোহ কেবল একটি রাজনৈতিক সংঘর্ষ নয়—এটি ছিল অত্যাচার, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক সামাজিক আন্দোলন। এই বিদ্রোহ প্রমাণ করে যে, মধ্যযুগীয় ভারতেও সাধারণ জনগণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সক্ষম ছিল। বাংলার ইতিহাসে কৈবর্ত বিদ্রোহ তাই ন্যায়বোধ, সমতা ও স্বাধীনতার প্রথম সামাজিক প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

📝 ২. আরবদের সিন্ধু বিজয়ের কারণ ও ফলাফল লেখো।

উত্তর :
ভারতবর্ষের ইতিহাসে আরবদের সিন্ধু বিজয় (৭১২ খ্রিষ্টাব্দ) একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি ছিল ভারতের সঙ্গে ইসলামী বিশ্বের প্রথম প্রত্যক্ষ সংঘাত, যার ফলশ্রুতিতে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী প্রভাব বিস্তারের পথ খুলে যায়। সিন্ধু বিজয় কেবল সামরিক অভিযান নয়, বরং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় দিক থেকেও তা ইতিহাসে এক গভীর ছাপ রেখে গেছে।

---

⚫ সিন্ধু বিজয়ের পটভূমি :

৭ম শতাব্দীর শেষভাগে সিন্ধু অঞ্চল ছিল হিন্দু শাসক দাহিরের অধীনে। তাঁর রাজধানী ছিল অলোর (বর্তমান পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদ)। সিন্ধু ছিল বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা—আরব, ইরান ও ভারতের মধ্যবর্তী সংযোগস্থল। এই অঞ্চলে আগে থেকেই বহু আরব বণিক বসবাস করত, যাদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের প্রভাব কিছুটা ছড়িয়েছিল।

---

⚫ আরবদের সিন্ধু বিজয়ের কারণ :

১. রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা :
খলিফা আল-ওয়ালিদ (Walid I) ইসলামী সাম্রাজ্যকে আরও বিস্তৃত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল সমগ্র পারস্য, আফগানিস্তান ও সিন্ধু পর্যন্ত ইসলামি প্রভাব বিস্তার।

২. অর্থনৈতিক কারণ :
সিন্ধু অঞ্চল ছিল সমুদ্রবাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র। আরব ব্যবসায়ীরা ভারতীয় বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তার করতে চাইত। সিন্ধু দখল মানে ভারতীয় বাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ পথ দখল করা।

৩. প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা :
কথিত আছে, আরব ব্যবসায়ীদের একটি জাহাজে করে উপহার সামগ্রী ও কিছু মুসলিম নারী-শিশু মক্কা থেকে সিন্ধুর বন্দরে পাঠানো হয়েছিল। পথে জলদস্যুরা সেই জাহাজ লুট করে বন্দীদের আটকায়। খলিফার প্রতিনিধি হজ্জাজ-বিন-ইউসুফ রাজা দাহিরের কাছে বন্দীদের মুক্তি দাবি করলে দাহির তা অস্বীকার করেন। এই ঘটনাকে অজুহাত করে আরবরা প্রতিশোধের অভিযানে নামে।

৪. ধর্মপ্রচারক মনোভাব :
তৎকালীন আরব সাম্রাজ্য ইসলাম ধর্ম প্রচারে উদ্দীপ্ত ছিল। “জিহাদ” বা ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষার প্রসার ছিল তাদের অন্যতম লক্ষ্য। সিন্ধু বিজয়ের মধ্য দিয়েও তারা ইসলাম প্রচারের সুযোগ খুঁজে পায়।

৫. দাহিরের প্রশাসনিক দুর্বলতা :
রাজা দাহির ছিলেন সাহসী কিন্তু দুর্বল কৌশলী শাসক। তাঁর রাজ্যের অনেক সামন্ত ও শাসক অসন্তুষ্ট ছিল। ফলে তিনি একতাবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি। এই অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাই আরব আক্রমণকে সহজ করে তোলে।

---

⚫ বিজয়ের বিবরণ :

হজ্জাজ-বিন-ইউসুফ প্রথমে উবাইদুল্লাহ ও বদিল নামের দুই সেনাপতিকে সিন্ধু আক্রমণে পাঠান, কিন্তু তারা ব্যর্থ হন। পরে তিনি তাঁর ভাগ্নে মুহাম্মদ-বিন-কাসিমকে (বয়স মাত্র ১৭ বছর) সেনাপতি নিযুক্ত করেন।

কাসিম শক্তিশালী আরব বাহিনী নিয়ে সিন্ধু আক্রমণ করেন। প্রথমে দেবল, পরে নীরুন (বর্তমান হায়দ্রাবাদ) দখল করেন। শেষ পর্যন্ত অলোর দুর্গে রাজা দাহিরের সঙ্গে এক তীব্র যুদ্ধ হয়। দাহির নিহত হন এবং সিন্ধু আরবদের অধীনে আসে (৭১২ খ্রিষ্টাব্দ)।

---

⚫ আরব শাসনের প্রতিষ্ঠা :

বিজয়ের পর মুহাম্মদ-বিন-কাসিম দক্ষ প্রশাসক হিসেবে সিন্ধু শাসন সংগঠিত করেন। তিনি স্থানীয় হিন্দু ও বৌদ্ধদের উপর জোরপূর্বক ধর্মান্তর চাপাননি। বরং কর আরোপ করে তাদের ধর্মপালনের স্বাধীনতা দেন। এর ফলে সাধারণ মানুষ তেমন প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি।

কাসিম মৃত্যুর পর আরব শাসনের প্রভাব কিছুটা হ্রাস পায়, কিন্তু সিন্ধু বহু বছর ধরে খলিফার অধীনে ছিল।

---

⚫ সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল :

১. ভারত-আরব সংযোগের সূচনা :
এই বিজয়ের মাধ্যমে ভারত ও আরব বিশ্বের মধ্যে প্রথমবারের মতো স্থায়ী যোগাযোগ গড়ে ওঠে। বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উভয় সভ্যতা একে অপরের প্রভাব অনুভব করে।

২. ইসলাম ধর্মের প্রবেশ :
সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রথম প্রবেশ ঘটে। যদিও এটি তখন সীমিত অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল, তবু এর প্রভাব ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়।

৩. প্রশাসনিক পরিবর্তন :
আরবরা সিন্ধু অঞ্চলে এক নতুন প্রশাসনিক পদ্ধতি প্রবর্তন করে। তারা কর ব্যবস্থা, ভূমি জরিপ, আইন ব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রে কিছু উন্নত নীতি চালু করে।

৪. সাংস্কৃতিক বিনিময় :
আরবদের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে ইসলামী শিক্ষা, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও দর্শনের সংযোগ ঘটে। পরবর্তীকালে এই সাংস্কৃতিক বিনিময় ভারতীয় সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করে।

৫. রাজনৈতিক প্রভাব :
যদিও আরবরা ভারতের গভীরে অগ্রসর হতে পারেনি, তবে তাদের এই বিজয় ভবিষ্যতে মুসলিম শাসনের (গজনবী, গুরী ও দিল্লি সালতানাত) পথ প্রস্তুত করে দেয়।

৬. স্থানীয় জনগণের অবস্থান :
কাসিমের প্রশাসনিক ন্যায্যতায় হিন্দু ও বৌদ্ধরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী আরব শাসকরা কর আদায়ে কঠোর হয়ে ওঠে। এতে বিদ্রোহ ও অসন্তোষ দেখা দেয়।

---

⚫ উপসংহার :

আরবদের সিন্ধু বিজয় ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি ছিল ভারতের সঙ্গে ইসলামী বিশ্বের প্রথম মিলনবিন্দু। যদিও এই বিজয় রাজনৈতিকভাবে স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারেনি, তবুও সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে এটি নতুন যুগের সূচনা করেছিল। সিন্ধু বিজয়ই পরবর্তীকালে মুসলিম শাসনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে, যা ভারতের ইতিহাসকে নতুন পথে পরিচালিত করে।

📝 ৩. পাল ও সেন যুগের সাহিত্য ও শিল্পচর্চার পরিচয় দাও।

উত্তর :
ভারতীয় তথা বাংলা ইতিহাসে পাল ও সেন যুগ (প্রায় ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দী) বাংলা সংস্কৃতি, সাহিত্য ও শিল্পকলার স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত। এই সময়ে বাংলার সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা ও শিল্পকলায় অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে। পাল যুগে বৌদ্ধ ধর্মবিশ্বাসের প্রভাব এবং সেন যুগে হিন্দু পুনর্জাগরণ—এই দুই ধারাই বাংলার সংস্কৃতিকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।

---

⚫ পাল যুগের সাহিত্যচর্চা :

ধর্মীয় সাহিত্যের বিকাশ :
পাল শাসকেরা ছিলেন মহাযান বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ও আধ্যাত্মিক সাহিত্য ব্যাপকভাবে রচিত হয়। নালন্দা, বিক্রমশীলা ও সোমপুর মহাবিহার এই সময়ে সাহিত্য ও শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

বৌদ্ধ সাহিত্যের প্রসার :
এই যুগে সংস্কৃত ও পালি ভাষায় বহু বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ রচিত হয়। যেমন — শান্তিদেবের “বোধিচর্যাবতারা”, অতীশ দীপঙ্করের “বোধিপথপ্রদীপ”, তরনাথের “বৌদ্ধগুরুপরম্পরা” ইত্যাদি। এসব গ্রন্থে নৈতিকতা, করুণা, ধ্যান ও মুক্তির পথ আলোচিত হয়েছে।

চর্যাপদ :
পাল যুগের সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হলো চর্যাপদ—যা বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন। ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে সিদ্ধাচার্যগণ এই পদগুলি রচনা করেন। চর্যাপদে গুহ্য তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের ভাব, মানবজীবনের দুঃখ ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, প্রেম ও ভক্তি কাব্যরূপে প্রকাশ পেয়েছে।
চর্যাপদে ব্যবহৃত ভাষা “আবহট্ট” হলেও তা প্রাচীন বাংলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। এর রচয়িতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য — লুইপা, কুক্কুরীপা, ভুসুকুপা, শবরপা, কানহপা প্রমুখ।

সংস্কৃত সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা :
পাল রাজারা সংস্কৃত ভাষাকেও সমানভাবে সমর্থন দেন। তাঁদের আমলে বহু কবি ও পণ্ডিত সংস্কৃত কাব্য, নাটক ও দর্শনগ্রন্থ রচনা করেন। যেমন — হরিবদ্র, রত্নাকরশান্তি, অভয়াকারগুপ্ত, দীপঙ্করশ্রীজ্ঞানের গুরু অতীশ প্রমুখ।

---

⚫ সেন যুগের সাহিত্যচর্চা :

ধর্মীয় পুনর্জাগরণ :
সেন রাজারা ছিলেন কঠোর হিন্দু শাসক। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু ধর্ম, পুরাণ ও সংস্কৃত সাহিত্য নতুন করে বিকাশ লাভ করে। বিশেষত শৈব, বৈষ্ণব ও শাক্ত সাহিত্যের প্রসার ঘটে।

সংস্কৃত সাহিত্যের বিকাশ :
সেন রাজাদের রাজসভা ছিল সংস্কৃত কবি, আলঙ্কারিক ও পণ্ডিতে পরিপূর্ণ।

• বলাল সেন রচনা করেন “দানসাগর” ও “অদ্ভুতসাগর”।

• লক্ষ্মণ সেনের রাজসভায় ছিলেন বিখ্যাত কবি জয়দেব, ধয়াননন্দ, গোবর্ধন আচার্য, উমাপতি ধর্ম প্রমুখ।

• জয়দেবের “গীতগোবিন্দ” কাব্য সেন যুগের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এতে কৃষ্ণ-রাধার প্রেমকে ভক্তিরসের আকারে প্রকাশ করা হয়েছে, যা পরবর্তী বৈষ্ণব পদাবলীর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।

বাংলা ভাষার বিকাশের সূচনা :
সেন যুগে বাংলা ভাষার প্রাথমিক বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। গ্রামীণ স্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন বৃদ্ধি পায়। রাজসভা যদিও সংস্কৃতনির্ভর ছিল, তবু ধর্মীয় উপাসনা, কীর্তন, পুরাণকথন প্রভৃতির মাধ্যমে বাংলার কথ্য ভাষা জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

---

⚫ পাল যুগের শিল্পচর্চা :

বৌদ্ধ শিল্পের শ্রেষ্ঠ সময় :
পাল যুগের শিল্পকলাকে বলা হয় “পাল স্কুল অফ আর্ট”। এর মূল কেন্দ্র ছিল নালন্দা, বিক্রমশীলা ও সোমপুর মহাবিহার। এই সময়ের মূর্তিশিল্পে বৌদ্ধ ধর্মের গভীর ভাবপ্রকাশ ও নান্দনিকতার সমন্বয় দেখা যায়।

মূর্তিশিল্প :
কালো পাথর, ধাতু ও মাটির মূর্তিতে গৌতম বুদ্ধ, অবলোকিতেশ্বর, তারা, মঞ্জুশ্রী প্রভৃতির অপূর্ব রূপচিত্র সৃষ্টি হয়। এসব মূর্তিতে মুখমণ্ডলের শান্ত ভাব, নিপুণ ভাস্কর্যশৈলী ও অলঙ্করণের সৌন্দর্য অনন্য।

স্থাপত্যকলার উৎকর্ষ :
পাল যুগে বহু মহাবিহার, স্তূপ ও মন্দির নির্মিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য — সোমপুর মহাবিহার (পাহাড়পুর), যা বর্তমানে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত।
এই স্থাপত্যে টেরাকোটা অলঙ্করণ, খিলান, স্তম্ভ ও খোদাই কাজ অসাধারণ শিল্পরুচির নিদর্শন।

চিত্রকলার বিকাশ :
পাল যুগে পাণ্ডুলিপি চিত্রায়ন বা “মিনিয়েচার পেইন্টিং” জনপ্রিয় হয়। তালপাতা ও তাম্রপত্রে ধর্মীয় দৃশ্য, বুদ্ধের জীবনী ও প্রাকৃতিক চিত্র অঙ্কিত হত।

---

⚫ সেন যুগের শিল্পচর্চা :

হিন্দু স্থাপত্যের বিকাশ :
সেন যুগে হিন্দু মন্দির স্থাপত্যে নতুন ধারা সূচিত হয়। বলাল সেন ও লক্ষ্মণ সেন রাজত্বকালে ইট ও পাথরের মন্দির নির্মাণে উৎকর্ষ দেখা যায়। এই সময়ের মন্দিরগুলো উত্তর ভারতীয় “নাগর শৈলী” অনুসারে নির্মিত।

ভাস্কর্য ও অলঙ্করণ :
পাল যুগের উত্তরাধিকারে সেন যুগেও মূর্তিশিল্প সমৃদ্ধ থাকে, তবে এতে হিন্দু দেবদেবীর প্রতিমূর্তি যেমন— শিব, দুর্গা, বিষ্ণু, গণেশ প্রভৃতি প্রধান হয়ে ওঠে। অলঙ্করণের সূক্ষ্মতা ও দেহরেখার কোমলতা এই যুগের বৈশিষ্ট্য।

চিত্র ও কারুকার্য :
এই সময়ে টেরাকোটা ফলক, মন্দিরভিত্তিক অলঙ্করণ এবং মূর্তিশিল্পে স্থানীয় রুচির প্রকাশ ঘটে। ধর্মীয় ভাবনায় সৃষ্ট শিল্পকর্মে সৌন্দর্য ও ভক্তির সংমিশ্রণ দেখা যায়।

---

⚫ উপসংহার :

পাল ও সেন যুগের সাহিত্য ও শিল্পচর্চা বাংলা সংস্কৃতির মজবুত ভিত্তি রচনা করে। পাল যুগে বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব, চর্যাপদের কাব্যধারা এবং নালন্দা-বিক্রমশীলার জ্ঞানচর্চা যেমন শিক্ষার বিকাশ ঘটায়, সেন যুগে হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃত সাহিত্য ও ভক্তিরসের কবিতা বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে।
এই দুই যুগের সাহিত্য ও শিল্পই পরবর্তীকালে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য, বিশেষত বৈষ্ণব পদাবলী, মঙ্গলকাব্য ও শিল্পধারার পেছনে গভীর প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।

📝 ৪. চোল রাজবংশের সামুদ্রিক কার্যকলাপ আলোচনা করো।

উত্তর :
চোল রাজবংশ দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় রচনা করেছিল। তারা কেবল স্থলসীমায় নয়, সমুদ্রপথেও তাদের প্রভাব বিস্তার করেছিল। চোলদের সামুদ্রিক কার্যকলাপ তাদের রাজনৈতিক শক্তি, বাণিজ্যিক উন্নতি, ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের প্রধান মাধ্যম ছিল। বিশেষত রাজরাজ চোল ও রাজেন্দ্র চোলের আমলে চোল নৌবাহিনী ভারত মহাসাগরে এক অপরাজেয় শক্তিতে পরিণত হয়।

---

🔹 সামুদ্রিক শক্তি ও নৌবাহিনীর বিকাশ :
চোল রাজারা দক্ষিণ ভারতের দীর্ঘ উপকূলরেখার কৌশলগত গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। রাজেন্দ্র চোল ও রাজরাজ চোল বিশেষভাবে নৌবাহিনী গঠনে মনোযোগ দেন। তারা শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করেন, যা দক্ষিণ ভারতের বন্দর যেমন কভার, নাগাপট্টিনম, পুহার, কুড্ডালুর প্রভৃতি থেকে পরিচালিত হতো।
চোল নৌবাহিনী ভারত মহাসাগরে তাম্রলিপ্ত, শ্রীলঙ্কা, মালয় ও ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত অভিযান চালায়। নৌবাহিনী ছিল চোল সাম্রাজ্যের শক্তির মেরুদণ্ড, যা শুধু যুদ্ধ নয়, বাণিজ্য ও কূটনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

---

🔹 সামুদ্রিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপ :
চোলরা সমুদ্রপথ ব্যবহার করে বিদেশের সঙ্গে ব্যাপক বাণিজ্য চালাত। দক্ষিণ ভারতের মশলা, বস্ত্র, রেশম, হাতির দাঁত, রত্ন, নীলমণি, ও ধাতু রপ্তানি হতো। অন্যদিকে আরব, চীন, শ্রীলঙ্কা, মালয় ও সুমাত্রা থেকে আমদানি করা হতো মসলা, সোনা, রেশম ও বিলাস দ্রব্য।
চোল বন্দরগুলি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। নাগাপট্টিনম ও পুহার বন্দরে চীনা ও আরব জাহাজ নিয়মিত নোঙর করত। এই বাণিজ্য থেকে রাজকোষে বিপুল অর্থ প্রবাহিত হতো, যা সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে।

---

🔹 দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অভিযান ও সামুদ্রিক সম্প্রসারণ :
রাজেন্দ্র চোল প্রথম (১০১৪–১০৪৪ খ্রি.) চোল নৌবাহিনীর শক্তি ব্যবহার করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অভূতপূর্ব সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন।
তিনি শ্রীবিজয় (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া ও মালয় দ্বীপপুঞ্জ) আক্রমণ করে দখল করেন। এই অভিযান চোলদের সামুদ্রিক প্রভাবকে আন্তর্জাতিক মাত্রা দেয়। শ্রীবিজয়ের রাজধানী পলেম্ব্যাং দখল করে রাজেন্দ্র চোল প্রমাণ করেন যে ভারত মহাসাগরের নৌবাণিজ্য পথের উপর চোলদের প্রাধান্য ছিল।
এই অভিযানের ফলে ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়।

---

🔹 সামুদ্রিক প্রশাসন ও নৌবন্দর পরিচালনা :
চোলরা তাদের নৌবন্দরগুলিকে দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমে পরিচালনা করত। প্রতিটি বন্দর অঞ্চলে “নগরভর” নামে কর্মকর্তা নিযুক্ত থাকতেন, যিনি বাণিজ্যিক কর সংগ্রহ ও বিদেশি বণিকদের তত্ত্বাবধান করতেন।
চোল সমাজে সমুদ্রগামী ব্যবসায়ীরা একটি সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন—যেমন “মানিগ্রামম” ও “আইনুরুভার”। এই সংগঠনগুলির সদস্যরা বিদেশে বাণিজ্য করতেন এবং চোল রাজাদের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পেতেন।

---

🔹 ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রসার :
চোলদের সামুদ্রিক কার্যকলাপ কেবল অর্থনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাদের মাধ্যমে হিন্দু ধর্ম, তামিল ভাষা, ও ভারতীয় স্থাপত্যশৈলী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের বহু প্রাচীন মন্দিরে তামিল প্রভাবের চিহ্ন আজও পাওয়া যায়। চোল রাজারা বিদেশে মন্দির নির্মাণেও অনুদান দিতেন।

---

🔹 উপসংহার :
চোল রাজবংশের সামুদ্রিক কার্যকলাপ তাদের রাজনৈতিক শক্তি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের মূল উৎস ছিল। তারা ভারতের প্রাচীন সামুদ্রিক ঐতিহ্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়।
চোলদের নৌবাহিনী শুধু বিজয়ের প্রতীকই নয়, বরং ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সাংস্কৃতিক সংযোগের সেতুবন্ধন রচনা করেছিল। তাই ইতিহাসবিদরা যথার্থই বলেন —
“চোলরা ছিল ভারতের প্রথম মহান নৌ-শক্তি, যারা ভারত মহাসাগরকে ভারতীয় প্রভাবের সাগর করে তুলেছিল।”

📝 ৫. পল্লব ও চোলদের স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার পরিচয় দাও।

উত্তর :
দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে পল্লব ও চোল যুগ শিল্প, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার সোনালী অধ্যায় রচনা করেছে। এই দুই রাজবংশ কেবল রাজনৈতিক প্রাধান্য অর্জন করেনি, বরং ভারতীয় শিল্পকলার বিকাশে অমর অবদান রেখেছে। তাদের স্থাপত্যের গরিমা, ভাস্কর্যের শৈল্পিক সূক্ষ্মতা ও চিত্রকলার আধ্যাত্মিকতা ভারতীয় সংস্কৃতির এক মহিমান্বিত পরিচয় বহন করে।

---

🔹 পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

পল্লব রাজবংশ (৬ষ্ঠ–৯ম শতক খ্রি.) দক্ষিণ ভারতের প্রথম যুগ যারা ধর্মীয় স্থাপত্যকে এক নতুন রূপ দেয়। বিশেষত মহেন্দ্রবর্মণ, নারসিংহবর্মণ ও রাজারাজা পল্লব শিল্প-সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা নেন।

🏛 স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য :

পল্লব স্থাপত্যের দুই প্রধান ধারা ছিল—
১. রক-কাট (শৈল খোদাই) স্থাপত্য, এবং
২. গঠনমূলক (Structural) মন্দির স্থাপত্য।

১. শৈল খোদাই মন্দির :
পল্লব রাজারা প্রথমে পাহাড় কেটে মন্দির খোদাই করতেন। এর উজ্জ্বল উদাহরণ হলো মহাবলীপুরমের মণ্ডপ ও রথমন্দিরসমূহ।

• “পঞ্চ রথ” (ধর্মরাজ, ভীম, অর্জুন, নকুল-সহদেব ও দ্রৌপদী রথ) তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

• এই মন্দিরগুলি একটিমাত্র শিলাখণ্ড থেকে খোদাই করা, যা স্থাপত্যকলার এক বিস্ময়কর উদাহরণ।

• মন্দিরের গাত্রে হিন্দু পুরাণের দেব-দেবীর ভাস্কর্য, নৃত্যরত অপ্সরা ও পৌরাণিক কাহিনি চিত্রিত হয়েছে।

২. গঠনমূলক মন্দির :
পরে পল্লবরা ইট ও পাথর দিয়ে মন্দির নির্মাণ শুরু করেন।

• কাঞ্চিপুরমের কৈলাসনাথ মন্দির ও শোর মন্দির (মহাবলীপুরম) এই ধরণের।

• এই মন্দিরে “দ্রাবিড় শৈলী”র সূচনা দেখা যায়, যা পরবর্তীকালে চোলদের দ্বারা পূর্ণতা পায়।

---

🎨 ভাস্কর্য :

পল্লব ভাস্কর্য ছিল জীবন্ত ও গতিময়।

• “গঙ্গা অবতরণ” বা “অর্জুনের তপস্যা” শিলাচিত্রে দেবতা, প্রাণী, ঋষি ও মানুষের মিশ্র সমাবেশে এক চিত্রময় জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে।

• মানব দেহের গঠন, মুখভঙ্গি, ও গাম্ভীর্য পল্লব ভাস্কর্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

• নারী মূর্তিগুলিতে কোমলতা ও লাবণ্য প্রকাশ পেয়েছে, আর দেবমূর্তিতে দৃঢ়তা ও আধ্যাত্মিকতা।

---

🖌 চিত্রকলা :

যদিও পল্লব যুগের অধিকাংশ চিত্র আজ বিলুপ্ত, তবুও কাঞ্চিপুরমের মন্দির প্রাচীর ও গুহামন্দিরে কিছু অংশে প্রাচীন ফ্রেস্কো পেইন্টিং বা প্রাচীরচিত্রের অবশিষ্ট চিহ্ন পাওয়া যায়।

• এই চিত্রগুলিতে ধর্মীয় ভাব, ভক্তি, ও রাজকীয় জীবনচিত্র ফুটে ওঠে।

---

🔹 চোল যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

চোল রাজবংশ (৯ম–১৩শ শতক খ্রি.) দক্ষিণ ভারতের শিল্পকলাকে নতুন উচ্চতায় উন্নীত করে। পল্লব স্থাপত্যের উপর ভিত্তি করে তারা বিশাল ও অলংকৃত মন্দির স্থাপত্যের সূচনা করেন।

🏛 স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য :

চোল স্থাপত্যের মূল কেন্দ্র ছিল তাঞ্জাভুর, গঙ্গাইকোন্ডচোলপুরম, ও দারাসুরম।

১. দ্রাবিড় শৈলীর পূর্ণতা :
চোল স্থাপত্যে দ্রাবিড় শৈলীর পরিণত রূপ দেখা যায়—

• মন্দিরের বিমান (গোপুরম বা স্তম্ভিত টাওয়ার) অত্যন্ত উঁচু ও শৈল্পিকভাবে নির্মিত।

• রাজরাজেশ্বর (বৃহদেশ্বর) মন্দির চোল স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ৬৬ মিটার উচ্চতার এই মন্দির সম্পূর্ণ গ্রানাইট দিয়ে নির্মিত।

• মন্দিরের ভেতরের করিডর, প্রাচীরচিত্র, ও দেবমূর্তিগুলি অসামান্য কারিগরি দক্ষতার পরিচায়ক।

২. রাজেন্দ্র চোলের গঙ্গাইকোন্ডচোলপুরম মন্দির পিতার ঐতিহ্যের উত্তরসূরী। স্থাপত্যে সৌন্দর্য, জটিলতা ও গাম্ভীর্যের মিশ্রণ রয়েছে।

---

🎨 ভাস্কর্য :

চোল যুগে ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের স্বর্ণযুগ শুরু হয়।

• “নটরাজ শিবমূর্তি” চোল ভাস্কর্যের সর্বোত্তম নিদর্শন।

• দেব-দেবীর ব্রোঞ্জ মূর্তিগুলিতে গতিময়তা, সৌন্দর্য ও ভক্তিভাব একই সঙ্গে মিশে আছে।

• পাথরের মূর্তিগুলিতেও মানব শরীরের অনুপম অনুপাত ও ভঙ্গিমার বাস্তব রূপায়ণ দেখা যায়।

---

🖌 চিত্রকলা :

চোল মন্দিরের অভ্যন্তরভাগে দেওয়ালে অঙ্কিত রঙিন চিত্রগুলিতে ধর্মীয় কাহিনি, নৃত্য, সংগীত, ও রাজদরবারের জীবনচিত্র দেখা যায়।

• তাঞ্জাভুর মন্দিরের প্রাচীরচিত্রে রাজা রাজা চোল ও তাঁর গুরু করুভুর দেউলের চিত্র আজও বিখ্যাত।

• চোল চিত্রকলায় রঙের গভীরতা, ভঙ্গিমার জীবন্ততা এবং আলো-আঁধারির মিশ্রণ এক অনন্য মাত্রা তৈরি করেছে।

---

🔹 উপসংহার :

পল্লবরা যেখানে ভারতীয় স্থাপত্যকলার ভিত স্থাপন করেন, চোলরা সেখানে তার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটান। পল্লবদের শৈলখোদাই মন্দির থেকে চোলদের আকাশচুম্বী বিমান—সবই ভারতীয় শিল্পের অবিনশ্বর ঐতিহ্য।
ভাস্কর্যে পল্লবদের প্রাণময়তা ও চোলদের ব্রোঞ্জ-নিপুণতা, আর চিত্রকলায় আধ্যাত্মিক গাম্ভীর্য—সব মিলিয়ে এই যুগকে যথার্থই বলা যায়—
“দক্ষিণ ভারতের শিল্পকলার স্বর্ণযুগ।”

📝 ৬. পাল, রাষ্ট্রকূট ও প্রতিহার রাজবংশের ত্রিশক্তি সংগ্রামের কারণ ও ফলাফল লেখো।

✅ উত্তর :
ভারতের প্রাচীন ইতিহাসে নবম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত এক দীর্ঘ রাজনৈতিক সংঘাতের যুগ ছিল, যা ইতিহাসে “ত্রিশক্তি সংগ্রাম” (Tripartite Struggle) নামে পরিচিত। এই সংঘাতে ভারতের তিনটি শক্তিশালী রাজবংশ—পাল, প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট—উত্তর ভারতের প্রাধান্য এবং কানৌজের কর্তৃত্ব অর্জনের জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এই সংগ্রাম দীর্ঘদিন ধরে উত্তর ভারতের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

---

🌿 সংগ্রামের কারণ

---

১. কানৌজের রাজনৈতিক ও কৌশলগত গুরুত্ব :
হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর (৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ) পর কানৌজ রাজ্য শাসকবিহীন হয়ে পড়ে। গঙ্গা-যমুনা উপত্যকার এই নগরটি উত্তর ভারতের রাজনীতির কেন্দ্র ছিল। যে রাজা কানৌজ দখল করত, তাকেই উত্তর ভারতের প্রভাবশালী রাজা বলা হতো। তাই তিন রাজবংশই কানৌজ দখলের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে।

২. উত্তর ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা :
প্রতিহার রাজারা গুর্জর-রাজপুতানার শাসক হিসেবে নিজেদের উত্তর ভারতের রক্ষক ভাবতেন। অন্যদিকে পাল রাজারা বঙ্গ ও বিহারের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রকূটরা দক্ষিণ ভারতের শক্তি হিসেবে উত্তরভারতে কর্তৃত্ব স্থাপনে আগ্রহী ছিলেন। ফলে উত্তর ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়।

৩. অর্থনৈতিক স্বার্থ ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ :
গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা ও কানৌজ অঞ্চল বাণিজ্য, কৃষি ও কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। যে রাজা এ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত, সে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক আধিপত্য লাভ করত। এই অর্থনৈতিক স্বার্থও সংগ্রামের অন্যতম কারণ।

৪. সাম্রাজ্য বিস্তারের রাজনৈতিক লোভ :
তিন রাজবংশই নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করে উপমহাদেশীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। তাই প্রত্যেকেই অন্যের শক্তি ভাঙতে চেয়েছিল, যা সংঘাতকে তীব্র করে তোলে।

---

⚔️ সংগ্রামের ধারা

---

• প্রথমে ধর্মপাল (পাল রাজবংশ) কানৌজ দখল করে নিজের প্রভাব বিস্তার করেন।

• এরপর নাগভট্ট দ্বিতীয় (প্রতিহার) ধর্মপালকে পরাজিত করে কানৌজ দখল করেন।

• কিছুদিনের মধ্যেই ধ্রুব ও গোবিন্দ তৃতীয় (রাষ্ট্রকূট রাজারা) উত্তর অভিযান চালিয়ে প্রতিহারদের পরাজিত করেন এবং কানৌজ পর্যন্ত তাদের প্রভাব বিস্তার করেন।

• তিন রাজবংশের মধ্যে এই দখল পাল্টাপাল্টি চলতে থাকে, কিন্তু কেউই স্থায়ীভাবে কানৌজের ওপর কর্তৃত্ব রাখতে পারেননি।

---

🌾 সংগ্রামের ফলাফল

---

১. উত্তর ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতা :
দীর্ঘকালব্যাপী এই যুদ্ধের ফলে উত্তর ভারতে স্থিতিশীল শাসনব্যবস্থা ভেঙে যায়। কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং স্থানীয় সামন্তরা শক্তি অর্জন করে।

২. দক্ষিণ ভারতের উত্থান :
উত্তর ভারতের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযোগে দক্ষিণ ভারতে চোল, পাণ্ড্য, চের রাজবংশের উত্থান ঘটে। রাষ্ট্রকূটদের শক্তিও ক্রমে দক্ষিণে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

৩. অর্থনৈতিক ক্ষতি :
অবিরাম যুদ্ধের ফলে কৃষি, বাণিজ্য ও জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। গঙ্গা উপত্যকা জনশূন্য ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে পড়ে, ফলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৪. আরব ও মুসলিম আক্রমণের পথ সুগম :
ত্রিশক্তি সংগ্রামের ফলে ভারতীয় রাজ্যগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে। ঐক্যের অভাবে পরবর্তীকালে মহম্মদ গজনী ও মহম্মদ ঘোরীর মতো বিদেশি আক্রমণকারীরা সহজেই ভারত আক্রমণ করতে সক্ষম হয়।

৫. সাংস্কৃতিক প্রভাব :
যদিও রাজারা একে অপরের সঙ্গে লড়াই করছিলেন, তবু এই সময়ে শিল্প, সাহিত্য ও ধর্মচর্চা অব্যাহত ছিল। পাল যুগে নালন্দা ও বিক্রমশীল বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রকূট যুগে এলোরার কৈলাসনাথ মন্দির, প্রতিহার যুগে মন্দির স্থাপত্য—এসবই এই সময়ের সাংস্কৃতিক কৃতিত্বের নিদর্শন।

---

✨ উপসংহার :
ত্রিশক্তি সংগ্রাম ভারতের ইতিহাসে এক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের যুগ। এই সংঘাত ভারতের ঐক্য নষ্ট করলেও রাজশক্তির পরিসীমা, সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে উন্মোচিত করেছিল।
তাই ইতিহাসবিদদের মতে—
“ত্রিশক্তি সংগ্রাম ভারতকে এক করল না, বরং ভাগ করল।”

📝 ৭. সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো।

✅ উত্তর:
সুলতান মাহমুদ গজনী (৯৭১–১০৩০ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন আফগানিস্তানের গজনী রাজ্যের বিখ্যাত শাসক, যিনি ভারতবর্ষে মোট ১৭ বার অভিযান পরিচালনা করেন। তাঁর ভারত অভিযান শুধু সামরিক সাফল্যের নয়, বরং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যেও পরিচালিত হয়েছিল। তাঁর আক্রমণগুলি ভারতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়।

ভারত অভিযানের কারণসমূহ :

প্রথম কারণ ছিল অর্থনৈতিক লোভ। সে সময় ভারত ছিল ধন-সম্পদে সমৃদ্ধ এক দেশ। গজনীর রাজকোষ ছিল সীমিত, অথচ মাহমুদকে বিশাল সেনাবাহিনী ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালাতে হত। ফলে তিনি ভারতের মন্দির ও নগরসমূহের বিপুল ধনসম্পদ দখল করে রাজকোষ পূর্ণ করতে চেয়েছিলেন। বিশেষত সোমনাথ মন্দিরের বিপুল রত্নভাণ্ডার তাঁর লোভের মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় কারণ ছিল রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। মাহমুদ চেয়েছিলেন সমগ্র মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারতের উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করতে এবং একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গঠন করতে। তিনি নিজেকে ইসলামের রক্ষক ও জেহাদের বাহক হিসেবে উপস্থাপন করেন, যা তাঁকে মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পথে এগিয়ে দেয়।

তৃতীয় কারণ ছিল ধর্মীয় উদ্দীপনা বা জেহাদ। মাহমুদ ছিলেন একজন গোঁড়া সুন্নি মুসলমান। তিনি ভারতবর্ষের হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে ইসলাম প্রচারকে নিজের ধর্মীয় কর্তব্য মনে করতেন। তাঁর অভিযানের ফলে অসংখ্য মন্দির ধ্বংস হয় এবং বিপুলসংখ্যক হিন্দু ধর্মীয় কেন্দ্র লুটপাটের শিকার হয়।

চতুর্থ কারণ ছিল গৌরবলাভ ও খ্যাতি অর্জন। মাহমুদ ‘গাজী’ বা ধর্মযোদ্ধা উপাধি অর্জন করতে চেয়েছিলেন। ভারতের বিরুদ্ধে তাঁর ধারাবাহিক অভিযান তাঁকে মুসলিম জগতে একজন পরাক্রমশালী সেনাপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

ভারত অভিযানের ফলাফল :

প্রথম ফলাফল ছিল অর্থনৈতিক শোষণ। মাহমুদের আক্রমণে ভারতীয় মন্দির, নগর ও রাজ্যসমূহের বিপুল ধনসম্পদ লুণ্ঠিত হয়। বিশেষত গুজরাটের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠনের ফলে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়, এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

দ্বিতীয় ফলাফল ছিল ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষতি। তাঁর অভিযানে বহু প্রাচীন মন্দির, মূর্তি, শিল্পকলা ও স্থাপত্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই ধ্বংসযজ্ঞ ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর গভীর আঘাত হানে এবং হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের মধ্যে বিভাজনের সূচনা করে।

তৃতীয় ফলাফল ছিল রাজনৈতিক প্রভাব। মাহমুদের অভিযানে ভারতীয় রাজন্যবর্গের পারস্পরিক বিরোধ ও দুর্বলতা প্রকাশ পায়। স্থানীয় রাজারা পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতে ব্যস্ত থাকায় তাঁরা গজনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি। ফলে পরবর্তীকালে মুহম্মদ ঘোরীর আক্রমণ ও দিল্লি সুলতানির প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।

চতুর্থ ফলাফল ছিল সাংস্কৃতিক সংস্পর্শ ও প্রভাব। মাহমুদের সঙ্গে বহু পণ্ডিত, শিল্পী ও স্থপতি ভারতে আগমন করেন। তাঁরা ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আরবি ও পারস্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটান। যদিও এটি সীমিত মাত্রায় ঘটেছিল, তবুও এই যোগাযোগ পরবর্তী মুসলিম শাসনকালের সাংস্কৃতিক বিকাশে ভূমিকা রাখে।

পঞ্চম ফলাফল হিসেবে বলা যায়, ইসলামের বিস্তার সীমিত হলেও রাজনৈতিক ভিত্তি মজবুত হয়। মাহমুদের অভিযানের মাধ্যমে ভারতীয় ভূখণ্ডে মুসলিম শাসনের প্রথম পদক্ষেপ স্থাপিত হয়, যা পরবর্তীকালে দিল্লি সুলতানির প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

উপসংহার :
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান ছিল লুণ্ঠন, ধর্মীয় প্রচার ও রাজনৈতিক সম্প্রসারণের মিশ্র ফল। তিনি সরাসরি ভারতের উপর স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও তাঁর আক্রমণ ভারতীয় সমাজে দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক বিভাজন, সাংস্কৃতিক ক্ষয়, এবং মুসলিম শাসনের ভিত্তি স্থাপন করে। তাঁর অভিযানে ভারতের ইতিহাস এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে, যা পরবর্তী মুসলিম শাসনের পূর্বসূচনা হয়ে ওঠে।

📝 ৮. তরাইনের প্রথম ও দ্বিতীয় যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো।

✅ উত্তর:
ভারতীয় ইতিহাসে তরাইনের প্রথম ও দ্বিতীয় যুদ্ধ (১১৯১ ও ১১৯২ খ্রিস্টাব্দ) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটি যুদ্ধ কেবল দুই রাজ্যের সংঘর্ষ নয়, বরং ভারতের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণকারী অধ্যায়। এই যুদ্ধের মাধ্যমে উত্তর ভারতে মুসলিম শাসনের স্থায়ী ভিত্তি স্থাপিত হয়। একদিকে ছিলেন প্রথম তরাইনের যুদ্ধে রাজপুত শাসক পৃথ্বীরাজ চৌহান, অন্যদিকে ঘুর সাম্রাজ্যের শাসক মুহম্মদ ঘোরী। এখন আমরা এই দুই যুদ্ধের কারণ, ঘটনাপ্রবাহ ও ফলাফল বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

---

তরাইনের প্রথম যুদ্ধ (১১৯১ খ্রিঃ)

কারণসমূহ:
প্রথমত, মুহম্মদ ঘোরীর ভারত জয়ের আকাঙ্ক্ষা। ঘোর শাসক মুহম্মদ ঘোরী চেয়েছিলেন ভারতবর্ষে স্থায়ী মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। গজনী সাম্রাজ্যের পতনের পর তিনি ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে সচেষ্ট হন।

দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য। ভারত ছিল ধনসম্পদে পরিপূর্ণ দেশ। ঘোরীর রাজকোষ দুর্বল ছিল, ফলে তিনি ভারতের বাণিজ্য কেন্দ্র ও ধনভাণ্ডার লুণ্ঠন করে নিজের রাজ্য সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলেন।

তৃতীয়ত, ধর্মীয় উদ্দেশ্য। ঘোরী ছিলেন এক গোঁড়া মুসলিম রাজা। ইসলাম প্রচার ও হিন্দু রাজ্য দমন তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।

চতুর্থত, রাজপুতদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ। রাজপুত রাজাদের মধ্যে ঐক্যের অভাব ছিল। পৃথ্বীরাজ চৌহান ও জয়চন্দ্রের বিরোধ ঘোরীর জন্য সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।

যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ:
মুহম্মদ ঘোরী সিন্ধু নদ অতিক্রম করে তরাইন অঞ্চলে (বর্তমান হরিয়ানার কাছে) পৌঁছান। পৃথ্বীরাজ চৌহান, কানৌজের জয়চন্দ্র ব্যতীত বহু রাজপুত রাজাকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরীর মোকাবিলা করেন। প্রথম যুদ্ধ ১১৯১ সালে সংঘটিত হয়। এতে রাজপুত বাহিনী বিশালসংখ্যক অশ্বারোহী ও হাতি নিয়ে আক্রমণ চালায়। ঘোরীর বাহিনী ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট কিন্তু শৃঙ্খলাবদ্ধ। তবুও, পৃথ্বীরাজের বাহিনীর সাহস ও ঐক্যে ঘোরী পরাজিত হন এবং আহত অবস্থায় পালিয়ে যান।

ফলাফল:
প্রথম তরাইনের যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহানের বিজয় ভারতীয়দের মধ্যে এক নবআত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে। কিন্তু পৃথ্বীরাজ বিজয়ের সুফল গ্রহণে ব্যর্থ হন। তিনি পরাজিত শত্রুর পিছু না নিয়ে তাকে পুনরায় শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ দেন। এটি পরবর্তী যুদ্ধে তাঁর পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

---

তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ (১১৯২ খ্রিঃ)

কারণসমূহ:
প্রথম তরাইনের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে এবং ভারতে স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ঘোরী নতুন বাহিনী নিয়ে পুনরায় আক্রমণ করেন। অন্যদিকে পৃথ্বীরাজ চৌহান পূর্বের বিজয়ে আত্মতৃপ্ত হয়ে যথাযথ প্রস্তুতি নেননি। রাজপুতদের মধ্যে ঐক্যহীনতা তখনও রয়ে গিয়েছিল।

যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ:
১১৯২ সালে তরাইনে আবার দুই বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এবার ঘোরী অত্যন্ত কৌশলপ্রবণ ছিলেন। তিনি প্রথমে দুর্বল বাহিনীকে সম্মুখে পাঠিয়ে রাজপুতদের আক্রমণ প্ররোচিত করেন। রাজপুত বাহিনী আক্রমণে এগিয়ে গেলে ঘোরী পিছন থেকে বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে আক্রমণ চালান। এই “ফাঁদ কৌশল” রাজপুতদের বিপর্যস্ত করে। পৃথ্বীরাজের বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তিনি বন্দি হন এবং পরে মৃত্যুদণ্ড পান।

ফলাফল:
দ্বিতীয় তরাইনের যুদ্ধ ভারতীয় ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মোড়।
প্রথমত, রাজপুতদের পরাজয় ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতার অবসান ঘটায়। উত্তর ভারতে মুসলিম শাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয়।

দ্বিতীয়ত, মুহম্মদ ঘোরীর সাম্রাজ্য বিস্তার। ঘোরী দিল্লি ও আজমের দখল নেন। পরে তিনি তাঁর সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবক-এর হাতে প্রশাসনের দায়িত্ব দেন, যিনি পরবর্তীকালে দিল্লি সুলতানি প্রতিষ্ঠা করেন।

তৃতীয়ত, রাজপুত শক্তির পতন। রাজপুত রাজারা পরস্পর বিরোধে লিপ্ত থাকায় সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি। ফলে তাঁদের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব কমে যায়।

চতুর্থত, ভারতে মুসলিম শাসনের সূচনা। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলামী শাসনের দ্বার খুলে যায়, যা প্রায় ছয় শতাব্দী ধরে ভারতের উপর প্রভাব বিস্তার করে।

পঞ্চমত, সামরিক ও কৌশলগত শিক্ষা। এই যুদ্ধ দেখায় যে শুধু বীরত্ব নয়, কৌশল ও সংগঠনের অভাব পরাজয় ডেকে আনে। ঘোরীর সংগঠিত সেনা ও পরিকল্পিত যুদ্ধনীতি রাজপুতদের অসংগঠিত বীরত্বের উপর বিজয়ী হয়।

---

উপসংহার :
তরাইনের প্রথম ও দ্বিতীয় যুদ্ধ ভারতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়। প্রথম যুদ্ধে রাজপুতদের জয় ভারতীয় গৌরবের প্রতীক হলেও দ্বিতীয় যুদ্ধে তাদের পরাজয় ভারতীয় স্বাধীনতার অবসান ঘটায়। এই যুদ্ধের ফলেই ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে মুসলিম শক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তী কালে দিল্লি সুলতানি ও মোগল শাসনের পথ সুগম করে। তরাইনের যুদ্ধ তাই ভারতীয় ইতিহাসে "রাজপুত যুগের অবসান" ও "মুসলিম যুগের সূচনা" হিসেবে চিহ্নিত।

📝 ৯. আদি-মধ্যযুগের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিচয় দাও।

✅ উত্তর:
ভারতের ইতিহাসে আদি-মধ্যযুগ (প্রায় ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। এই সময়ে ভারতের রাজনৈতিক কাঠামো যেমন বদলেছিল, তেমনি অর্থনৈতিক জীবনেও ঘটে বড় পরিবর্তন। গুপ্তযুগের পরবর্তী সমাজে রাজ্যগুলি খণ্ডিত হলেও কৃষি, হস্তশিল্প, এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দেখা যায় উন্নতি ও নতুন ধারা। এই সময়ে গ্রামীণ অর্থনীতি, নগরায়ণ, বণিকগোষ্ঠী, বাজার ব্যবস্থা ও কর প্রথার বিশেষ বিকাশ ঘটে। নিচে আদি-মধ্যযুগের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হল।

---

১. কৃষিনির্ভর অর্থনীতি

আদি-মধ্যযুগের অর্থনীতির ভিত্তি ছিল কৃষি। জমিই ছিল সম্পদের মূল উৎস।
কৃষি উৎপাদনের উন্নতির জন্য জলাধার, খাল, বাঁধ ইত্যাদি নির্মাণ করা হতো।
দক্ষিণ ভারতে চোল রাজারা কৃষির উন্নতির জন্য সেচব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন।
উত্তর ভারতে গঙ্গা-যমুনা অববাহিকা ছিল প্রধান কৃষিক্ষেত্র।
চাষের জন্য জমি রাজা, মন্দির ও জমিদারদের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। কৃষকেরা রাজাকে ভূমিকর দিতেন, যা “ভাগভোগ” বা “ভাগকর” নামে পরিচিত ছিল।
অর্থনীতির মূল চাকা ছিল গ্রামসমাজ, যেখানে কৃষকই ছিল উৎপাদনের প্রধান শক্তি।

---

২. ভূমি অনুদান ও সামন্তপ্রথা

এই যুগে ভূমি অনুদান প্রথা বা অগ্রহার, ব্রাহ্মদেয়, দেবভোগ প্রথার বিকাশ ঘটে।
রাজারা ব্রাহ্মণ, মঠ, মন্দির বা সৈন্যবাহিনীকে ভূমি দান করতেন।
এর ফলে কৃষকরা সরাসরি রাজার পরিবর্তে জমিদার বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে কর দিতে বাধ্য হতেন।
এই ভূমি অনুদান প্রথা থেকেই সামন্তপ্রথার উত্থান ঘটে।
সামন্তরা রাজাকে সামরিক সহায়তা দিত, বিনিময়ে জমি পেত এবং কৃষকদের থেকে কর আদায় করত।
ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি ক্রমশ সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর অধীন হয়।

---

৩. হস্তশিল্প ও শিল্প উৎপাদন

কৃষির পাশাপাশি আদি-মধ্যযুগে হস্তশিল্প ও কারুশিল্পের বড়ো উন্নতি হয়।
তাঁতশিল্প, মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প, গয়নানির্মাণ, নৌকা নির্মাণ ইত্যাদি শিল্পে বহু মানুষ যুক্ত ছিল।
বঙ্গ, মাগধ, কাশী, উজ্জয়িনী, কাঞ্চি, মাদুরাই প্রভৃতি স্থানে শিল্পকর্মের খ্যাতি ছিল।
বঙ্গদেশের রেশম ও তুলার কাপড়, দক্ষিণ ভারতের মশলা, কর্ণাটকের লোহার সামগ্রী বিদেশে রপ্তানি হতো।
রাজারা শিল্পীদের রাজসভার অন্তর্ভুক্ত করতেন এবং রাজনগরে তাঁদের বসবাসের সুযোগ দিতেন।

---

৪. দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য

এই সময়ে দেশীয় বাণিজ্যের বিস্তার ঘটে।
বড় বড় গ্রাম, শহর ও নগরগুলিতে নিয়মিত বাজার বা ‘হাট’ বসত।
বণিকগোষ্ঠী বা শ্রেণী, যেমন “শ্রেণি”, “শ্রেণিক” ও “নিগম” (guild), বাণিজ্যের মূল চালিকাশক্তি ছিল।
এই বণিকরা পণ্য পরিবহনের জন্য গরুর গাড়ি, নৌকা, এমনকি উটও ব্যবহার করত।
প্রধান বাণিজ্যপণ্য ছিল ধান, তেলবীজ, কাপড়, ধাতু, গয়না, মশলা, চিনি ইত্যাদি।
রাজারা বাণিজ্যের নিরাপত্তা ও পথরক্ষার জন্য কর ও শুল্ক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতেন।

---

৫. আন্তর্জাতিক বাণিজ্য

আদি-মধ্যযুগেও ভারতের বিদেশি বাণিজ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল।
আরব, পারস্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীন ও আফ্রিকার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় ছিল।
চোল রাজারা সমুদ্রপথে শ্রীলঙ্কা, মালয়, সুমাত্রা, জাভা পর্যন্ত বাণিজ্য সম্প্রসারিত করেছিলেন।
আরব বণিকরা ভারতীয় উপকূলে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করেছিল—যেমন কেরালার কোঝিকোড়, কায়াল ও সোপার।
রপ্তানিপণ্য হিসেবে ভারত থেকে যেত রেশম, তুলা, মশলা, মুক্তা, হাতির দাঁত, মূল্যবান পাথর।
আমদানিপণ্য হিসেবে আসত ঘোড়া, কাচ, ধাতু ও সুগন্ধি দ্রব্য।

---

৬. মুদ্রা ও করব্যবস্থা

এই সময়ে স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রার প্রচলন ছিল।
গুপ্তযুগের মুদ্রা প্রথা অব্যাহত থেকেছে, তবে আঞ্চলিক রাজ্যগুলির নিজস্ব মুদ্রাও চালু হয়।
চোল, পাল ও সেন রাজাদের নামে উৎকীর্ণ মুদ্রা পাওয়া যায়।
রাজস্ব সংগ্রহের প্রধান উৎস ছিল ভূমিকর।
তাছাড়াও বাজারশুল্ক, সড়কশুল্ক, বন্দরকর, পণ্যকর প্রভৃতি রাজকোষের আয় বাড়াত।

---

৭. নগরায়ণ ও বণিক সমাজ

যদিও গ্রাম ছিল অর্থনীতির কেন্দ্র, তবু নগরজীবন পুনর্জাগরিত হয়েছিল।
মহানগরগুলি ছিল বাণিজ্য ও কারুশিল্পের কেন্দ্র।
নাগরিকদের মধ্যে বণিক, কারিগর, ব্রাহ্মণ, সৈন্য, সরকারি কর্মচারী প্রভৃতি শ্রেণি ছিল।
বণিকগোষ্ঠীগুলির আর্থিক প্রভাব ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
অনেক বণিক মন্দির ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দান করে সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করতেন।

---

৮. অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক প্রভাব

ভূমি অনুদান প্রথা ও সামন্ততন্ত্রের ফলে সমাজে ধনবৈষম্য বাড়তে থাকে।
ভূস্বামী ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে বিপুল সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়, আর কৃষক শ্রেণি নিপীড়িত হয়।
তবুও, কৃষি ও বাণিজ্যের বিস্তারের ফলে ভারতের সামগ্রিক অর্থনীতি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ছিল।

---

উপসংহার :

আদি-মধ্যযুগের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর, সামন্ততান্ত্রিক ও বাণিজ্যনির্ভর ছিল।
যদিও রাজনৈতিকভাবে ভারত বহু রাজ্যে বিভক্ত ছিল, তবু অর্থনৈতিক জীবনে এক প্রকার স্থিতি ও সমৃদ্ধি ছিল।
এই যুগের কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের সমন্বিত বিকাশ ভারতের সমাজ-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে এবং পরবর্তী মুসলিম শাসনের অর্থনৈতিক ভিত্তি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
সুতরাং, আদি-মধ্যযুগের অর্থনীতি ছিল ভারতের ইতিহাসে “গ্রামীণ স্বনির্ভরতা ও আন্তর্জাতিক সংযোগের যুগ” — যেখানে দেশীয় শ্রম, কৃষি ও বাণিজ্যের সম্মিলিত বিকাশের মাধ্যমে এক সুসংগঠিত অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে ওঠে।

📝 ১০. আদি-মধ্যযুগের বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের পরিচয় দাও।

✅ উত্তর:
ভারতের আদি-মধ্যযুগ (প্রায় ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ) ধর্মীয় ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। এই সময়ে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম তাদের প্রাচীন শক্তি ও প্রভাব অনেকাংশে হারালেও সমাজে, সংস্কৃতিতে ও দর্শনে তাদের প্রভাব বিদ্যমান ছিল। গুপ্তযুগের পরবর্তী সময়ে হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণের ফলে এদের অনুসারীর সংখ্যা হ্রাস পায়, তবুও তারা ধর্মতত্ত্ব, শিল্পকলা, শিক্ষা ও নৈতিকতায় ভারতীয় সভ্যতার ধারাকে সমৃদ্ধ করে তোলে। নিচে এই দুই ধর্মের অবস্থান, রূপ ও প্রভাব বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হল।

---

১. ঐতিহাসিক পটভূমি

গুপ্তযুগের পতনের পর ভারতের রাজনীতি খণ্ডিত হয়ে পড়ে। একাধিক আঞ্চলিক রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। এই সময়ে ধর্মজীবনেও নানা রূপান্তর দেখা যায়।
হিন্দুধর্ম ব্রাহ্মণ্য প্রভাব নিয়ে পুনরুজ্জীবিত হয়, শৈব, বৈষ্ণব ও শক্তপন্থা জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
তবুও বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম তখনও রাজারা, ধনী শ্রেণি এবং বণিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় টিকে ছিল।
এদের মঠ, বিহার ও তীর্থস্থানগুলি শিক্ষাকেন্দ্র ও ধর্মপ্রচারক কেন্দ্র হিসেবে রয়ে যায়।

---

২. আদি-মধ্যযুগে বৌদ্ধ ধর্মের অবস্থা

আদি-মধ্যযুগে বৌদ্ধ ধর্ম তিনটি প্রধান শাখায় বিভক্ত ছিল— থেরবাদ, মহাযান ও বজ্রযান।
এই বিভাজনই মূলত বৌদ্ধ ধর্মকে দুর্বল করে তোলে।

(ক) থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম

থেরবাদ বা হীনযান মূলত শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রচলিত ছিল।
এই ধারার অনুসারীরা ব্যক্তিগত মুক্তি ও সংযমের ওপর জোর দিতেন।
ভারতে এর প্রভাব ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে পড়ে।

(খ) মহাযান বৌদ্ধধর্ম

মহাযান শাখা করুণা ও বোধিসত্ত্ব ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
এই ধারার বৌদ্ধরা ভক্তিপূর্ণ উপাসনা, মূর্তি ও বিহার কেন্দ্রিক ধর্মচর্চায় মনোযোগী হন।
গুপ্তোত্তর কালে বিহার, নালন্দা, বিক্রমশীলা, সোমপুর প্রভৃতি স্থানে মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ ঘটে।
এই বিদ্যালয়গুলিতে দর্শন, যুক্তি, চিকিৎসা, ব্যাকরণ, গণিত প্রভৃতি বিদ্যার পাঠ দিতেন।

(গ) বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম

৮ম শতাব্দীতে পূর্ব ভারতের বিহার ও বঙ্গ অঞ্চলে বজ্রযান বা গুপ্ত তন্ত্রমার্গের উত্থান ঘটে।
এটি ছিল এক সংমিশ্রিত ধর্ম—যেখানে তন্ত্র, যোগ, মন্ত্র ও দেবদেবীর উপাসনা প্রচলিত হয়।
এই ধারায় দেবী তারা, বজ্রপাণি, অবলোকিতেশ্বর প্রভৃতি দেবতার পূজা প্রচলিত হয়।
রাজা পাল বংশের শাসকরা বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
পালযুগে নালন্দা, বিক্রমশীলা, সোমপুর মহাবিহার বৌদ্ধ শিক্ষার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

---

৩. বৌদ্ধ ধর্মের অবনতি

আদি-মধ্যযুগের শেষে ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের অবনতি ঘটে। এর প্রধান কারণ ছিল—

• হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন ও তন্ত্রসাধনার সঙ্গে মিশে বৌদ্ধ ধর্মের স্বাতন্ত্র্য হারানো।

• মঠবাসীদের বিলাসিতা ও সমাজজীবন থেকে বিচ্ছিন্নতা।

• বিদেশি আক্রমণ, বিশেষত ১২শ শতাব্দীতে তুর্কি সেনানীর হাতে নালন্দা ও বিক্রমশীলা ধ্বংস।
  ফলে বৌদ্ধ ধর্ম ধীরে ধীরে ভারত থেকে বিলুপ্ত হয়ে পড়ে, তবে তা চীন, জাপান, তিব্বত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে যায়।

---

৪. আদি-মধ্যযুগে জৈন ধর্মের অবস্থা

বৌদ্ধ ধর্মের মতো জৈন ধর্মও প্রাচীন ভারতের একটি তপস্যা ও নৈতিকতানির্ভর ধর্ম।
মহাবীরের প্রদত্ত অহিংসা, সত্য, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহের আদর্শ এই যুগেও অনুসৃত ছিল।
আদি-মধ্যযুগে জৈন ধর্ম দুই শাখায় বিভক্ত হয়— দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর।

(ক) দিগম্বর সম্প্রদায়

দিগম্বর সম্প্রদায় মূলত দক্ষিণ ভারতে প্রভাব বিস্তার করে।
তারা দেহাবরণ পরিত্যাগ করে কঠোর তপস্যা ও দারিদ্র্য জীবনকে ধর্মের মূল অংশ বলে মনে করত।
চালুক্য, রাষ্টকূট ও হোয়সাল রাজারা দিগম্বরদের পৃষ্ঠপোষকতা দেন।

(খ) শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়

শ্বেতাম্বররা উত্তর ভারতে প্রচলিত ছিলেন। তারা সাদা বস্ত্র পরিধান করতেন।
গুজরাট, রাজস্থান ও মধ্যভারতের বিভিন্ন স্থানে তাঁদের মন্দির নির্মিত হয়।
এই সময়ে অসংখ্য জৈন তীর্থস্থান ও মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়—বিশেষত পার্শ্বনাথ, রণকপুর, দিলওয়াড়া প্রভৃতি।

---

৫. জৈন ধর্মের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

জৈন ধর্ম অহিংসা ও জীবদয়ার আদর্শে সমাজে মানবিকতা প্রচার করে।
বণিক শ্রেণি জৈন ধর্মে ব্যাপকভাবে দীক্ষিত ছিল, ফলে ধর্মীয় দান ও শিক্ষা কার্যক্রমে অর্থসাহায্য পেত।
চোল, রাষ্টকূট ও গুর্জর-প্রতিহার রাজারা জৈন মন্দির নির্মাণে সহায়তা দেন।
জৈন ধর্ম থেকে তামিল, কন্নড় ও প্রাকৃত সাহিত্যেরও বিকাশ ঘটে।
সোমদেবের কথাসরিতসাগর, হেমচন্দ্রের অভিধানচিন্তামণি প্রভৃতি গ্রন্থ এই সময়ের উল্লেখযোগ্য রচনা।

---

৬. বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের পারস্পরিক মিল

উভয় ধর্মই তপস্যা, নৈতিকতা, অহিংসা ও মুক্তির আদর্শে বিশ্বাসী।
দু’ধর্মেই ব্রাহ্মণ্যযজ্ঞ ও প্রাণীহত্যার বিরোধিতা করা হয়েছিল।
দু’ধর্মই সমাজে মানবিক মূল্যবোধ, দয়া ও সমতার ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছিল।

---

৭. ধর্মগুলির পতনের কারণ

আদি-মধ্যযুগে উভয় ধর্মই ক্রমে হিন্দু তন্ত্র ও ভক্তিমার্গের সঙ্গে মিশে তাদের মৌলিক চরিত্র হারায়।
মঠবাসীরা সমাজজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, ফলে সাধারণ মানুষের সংযোগ দুর্বল হয়।
পরবর্তীকালে মুসলিম আক্রমণে এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

---

উপসংহার :

আদি-মধ্যযুগে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম যদিও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা হারিয়েছিল, তবুও তারা ভারতের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।
বৌদ্ধ ধর্মের করুণাময়তা ও জৈন ধর্মের অহিংসা-নীতির সংমিশ্রণে ভারতীয় ধর্মচেতনা মানবিকতা ও সহনশীলতার পথে অগ্রসর হয়।
তাদের মঠ, বিহার, শিল্প, সাহিত্য ও দর্শন আজও ভারতীয় ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদ।
অতএব, আদি-মধ্যযুগ ছিল বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অবক্ষয়ের যুগ হলেও সাংস্কৃতিক উজ্জ্বলতার যুগ, যা ভারতীয় সভ্যতার মানবতাবাদী ভিত্তিকে আরও সুদৃঢ় করেছে।

<<<<<<<<<<<<<<<<🌹সমাপ্ত🌹>>>>>>>>>>> 

👉For pdf whatsapp-8250978714