📚উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস সাজেশন-২০২৫(উত্তরসহ):প্রশ্নের মান-৮📚
✍️প্রশ্নের মান-৮:
১.সাম্রাজ্যবাদ কাকে বলে? সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের কারণগুলি আলোচনা করো।
উঃ সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা:
সাম্রাজ্যবাদ, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হল ‘Imperialism’, শব্দটি লাতিন ‘ইম্পেরিয়াম’ থেকে এসেছে। প্রাথমিকভাবে এটি সামরিক কর্তৃত্বের অর্থে ব্যবহৃত হতো, কিন্তু সময়ের সঙ্গে এর অর্থ পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী দেশ অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশের উপর বলপূর্বক প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, যা তাদের স্বার্থে শাসন ও শোষণের কাজ করে।
লেনিনের মতে, সাম্রাজ্যবাদ হলো ‘পুঁজিবাদের একচেটিয়া পর্যায়’। জে.এ.হবসনের মতে, প্রাথমিক স্তরে জাতীয়তাবোধ অন্য দেশে উপনিবেশ গড়ে তোলার প্রেরণা জোগায়, যা পরবর্তীতে সাম্রাজ্যবাদের রূপ নেয়।
সাম্রাজ্যবাদ উদ্ভবের কারণ:
ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য বৃদ্ধি করা। অধ্যাপক জেমস জোরের মতে, সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণের জন্য একক কোনো কারণ যথেষ্ট নয়। ভিন্ন ভিন্ন পণ্ডিত ও ঐতিহাসিকরা আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করেছেন।
রাজনৈতিক কারণ:
1. উগ্র জাতীয়তাবাদ: 1870 সালের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উগ্র জাতীয়তাবোধ মাথা চাড়া দেয়। বিভিন্ন জাতি নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে, যা প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করে। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় দেশগুলি এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলিতে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করার চেষ্টা করে।
2. ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা: জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের সম্মান ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধির জন্য ইউরোপীয় দেশগুলি উপনিবেশ স্থাপন করতে আগ্রহী হয়।
অর্থনৈতিক কারণ:
বিভিন্ন ইতিহাসবিদ এবং অর্থনীতিবিদরা আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের প্রসারে অর্থনৈতিক কারণকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।
1. পণ্য বিক্রির বাজার: অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ইংল্যান্ড এবং পরে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে শিল্প বিপ্লব শুরু হলে বিপুল পরিমাণে পণ্য উৎপাদিত হতে থাকে। ইউরোপের সব দেশেই শিল্প বিপ্লবের ফলে উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রির জন্য ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলি এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটায়।
2. কাঁচামাল সংগ্রহ: শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলির জন্য প্রচুর পরিমাণ কাঁচামালের প্রয়োজন হয়, যা স্থানীয় উৎস থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। সুতরাং, তারা উপনিবেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে বাধ্য হয়।
3. পুঁজি বিনিয়োগ: হবসনের মতে, পুঁজিপতিরা তাদের হাতে সঞ্চিত মূলধন উপনিবেশগুলিতে বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জনের জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। লেনিন বলেছেন, পুঁজিপতিরা বাজার দখলের চেয়ে উপনিবেশে পুঁজি বিনিয়োগ করতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন।
4. শ্রমিক সংগ্রহ: শিল্পোন্নত দেশগুলির কলকারখানায় কাজ করার জন্য প্রচুর সুলভ ও দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল। এই প্রয়োজন মেটাতে ইউরোপীয় দেশগুলি অনগ্রসর দেশে সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করতে শুরু করে।
সামরিক কারণ:
ইউরোপীয় দেশের সামরিক বাহিনী আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত ছিল। এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার অনুন্নত দেশগুলির পক্ষে ইউরোপীয়দের প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল না, যার ফলে তারা ওই অঞ্চলে সাম্রাজ্য স্থাপন করে।
সাংস্কৃতিক কারণ:
অনেক সময় সাম্রাজ্যবাদের সমর্থকরা পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে সভ্যতা ও সংস্কৃতির আলোর শিখা প্রজ্বলনের আদর্শের আড়ালে সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ পরিচালনা করেন। ব্রিটিশ কবি কিপলিং এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “পৃথিবীর পিছিয়ে পড়া অংশে সভ্যতার আলো নিয়ে আসার শ্বেতকায় হাতির দায়িত্ব।”
উপসংহার:
সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের পেছনে একাধিক কারণ ছিল। ইউরোপীয় শক্তিবর্গের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছিল, যা বিশ্বকে একটি মহাযুদ্ধের সিংহদ্বারে নিয়ে যায়। সাম্রাজ্যবাদ কেবল রাজনৈতিক শোষণই নয়, বরং সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক শোষণের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা স্থানীয় জনগণের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
সাম্রাজ্যবাদ একটি জটিল প্রক্রিয়া, যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক কারণগুলো দ্বারা পরিচালিত হয়।
2.অতীতকে স্মরণ করার ক্ষেত্রে কিংবদন্তি ও স্মৃতিকথার গুরুত্ব আলোচনা করো।
উঃ
কিংবদন্তি:
'কিংবদন্তি' শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ 'Legenda' থেকে, যার অর্থ ‘পড়ার বিষয়বস্তু’। ইংরেজি ‘লেজেন্ড’ এর সুনির্দিষ্ট বাংলা প্রতিশব্দ না থাকলেও কিংবদন্তির মর্মার্থ হলো—এমন কোনো গল্প বা কাহিনী যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়ে এবং কোনো জাতি বা দেশের গৌরবকে প্রতিষ্ঠিত করে। এই ধরনের গল্পকথার আংশিক হলেও ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকে, যেমন রঘু ডাকাতের কালীপুজোর কিংবদন্তি, যার সূত্র ধরে একটি কালীমন্দির চিহ্নিত করা হয়েছে।
কিংবদন্তির গুরুত্ব:
মৌখিক ইতিহাসের উপাদান হিসেবে কিংবদন্তির কিছু গুরুত্ব রয়েছে, যেমন—
1.ঐতিহাসিক তথ্যের সূত্র: কিংবদন্তি পুরোপুরি কাল্পনিক নয়; এতে বাস্তবতার কিছু ছোঁয়া থাকে। উদাহরণস্বরূপ, রঘু ডাকাতের কিংবদন্তি থেকে কালীপুজো ও একটি কালীমন্দিরের ইতিহাস জানা যায়।
2. আনন্দদানের উপাদান: কিংবদন্তি বিভিন্ন আনন্দদায়ক উপাদান বহন করে, যা মানুষকে বংশ পরম্পরায় বিনোদন দিয়ে এসেছে।
3.শিক্ষাদান: কিংবদন্তির কাহিনীগুলি নৈতিকতা, বীরত্ব প্রভৃতি বিষয়ে বর্তমান সমাজকে শিক্ষা দেয়, যা মানুষকে সতর্কতা অবলম্বন করতে উৎসাহিত করে।
স্মৃতিকথা:
আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো স্মৃতিকথা। এটি মূলত কোনো ব্যক্তি তার জীবনের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির ভিত্তিতে রচিত বিবরণ।
স্মৃতিকথার গুরুত্ব:
1.গুণীজনের বিবরণ: অধিকাংশ স্মৃতিকথা গুণী ব্যক্তিদের দ্বারা রচিত, ফলে এতে পক্ষপাত বা অতিরঞ্জনের সম্ভাবনা কম থাকে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালীদের অবদানের কথা জানা যায়।
2. প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ: স্মৃতিকথায় ঐতিহাসিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক সত্যতা যাচাই করতে সহায়ক।
3. ঐতিহাসিক রচনার ক্ষেত্রে গুরুত্ব: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণের উপর পাকবাহিনীর বর্বরতার প্রমাণ অনেক স্মৃতিকথায় সংরক্ষিত রয়েছে, যা ঐতিহাসিক তথ্যের মূল্যবান উৎস।
4. নিজস্ব অনুভূতির প্রকাশ: স্মৃতিকথায় লেখক বা বক্তার ব্যক্তিগত অনুভূতি, অভিজ্ঞতা এবং ঘটনার প্রভাবের বিবরণ থাকে, যা ওই সময়ের পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট ধারণা দেয়।
3.পেশাদারি ইতিহাস কাকে বলে? পেশাদারি ও অপেশাদারী ইতিহাসের পার্থক্য আলোচনা করো।
উঃ
ইতিহাস হলো মানব সভ্যতার স্মৃতি ও তার কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিক বিবরণ। ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে অতীতের ঘটনা, সমাজব্যবস্থা, সংস্কৃতি এবং মানুষের জীবনধারা সম্পর্কে জানা যায়। যারা পেশাদারভাবে ইতিহাস চর্চা করেন, তারা পেশাদারী ইতিহাসবিদ হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে, শখের বসে ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন যারা, তাদেরকে বলা হয় অপেশাদার ঐতিহাসিক। বর্তমানকালে, বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পেশাদার ভিত্তিতে ইতিহাসের গবেষণা কাজ অব্যাহত রয়েছে। এই প্রবন্ধে পেশাদারী ও অপেশাদারী ইতিহাসের মধ্যে মূল পার্থক্যগুলি বিশ্লেষণ করা হলো।
উদ্ভবগত পার্থক্য:
উনিশ শতকের শেষভাগে জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ইউরোপের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পেশাদার ভিত্তিতে ইতিহাস চর্চার সূচনা হয়। এই সময়ে ইতিহাস গবেষণায় নতুন ধারা সূচিত হয় এবং ইতিহাস চর্চাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় পেশাদারী ইতিহাসবিদদের প্রভাব ক্রমে বৃদ্ধি পায়।
অন্যদিকে, অপেশাদার ইতিহাসচর্চার সূচনা অনেক আগেই হয়েছে। হেরোডোটাস এবং থুকিডিডিসের মতো ইতিহাসবিদরা প্রাচীন সময়ে ইতিহাস লিখলেও, তারা শখের ভিত্তিতে এ কাজ করতেন। তাঁদের চর্চায় পেশাদারিত্বের কোনো সুস্পষ্ট ছাপ ছিল না।
আর্থিক পার্থক্য:
পেশাদার ইতিহাসচর্চায় আর্থিক বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। পেশাদার ইতিহাসবিদরা বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের আর্থিক সহায়তা পান, এবং গবেষণার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ থাকে। ফলে, ইতিহাস চর্চায় তাদের আর্থিক সুবিধা লাভের সুযোগ থাকে।
অন্যদিকে, অপেশাদার ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে সাধারণত সরকারি সহায়তা পাওয়া যায় না। গবেষকরা ব্যক্তিগত অর্থায়নে তাদের ইতিহাস চর্চা করেন এবং এ কাজে আর্থিক লাভের সুযোগ খুবই সীমিত।
পদ্ধতিগত পার্থক্য:
পেশাদারী ইতিহাসবিদরা আধুনিক এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন। তারা তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, এবং উপস্থাপনার জন্য নির্দিষ্ট গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করেন।
অন্যদিকে, অপেশাদার ঐতিহাসিকগণ সাধারণত স্থানীয় তথ্যাদি, ক্ষেত্রসমীক্ষা, সাক্ষাৎকার প্রভৃতি পদ্ধতির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন।
সময়গত পার্থক্য:
পেশাদার ইতিহাসবিদরা পূর্ণসময়ের কাজ হিসেবে ইতিহাস গবেষণা করেন। তাদের পেশাগত পরিচিতি এবং জীবিকা ইতিহাস চর্চার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
অন্যদিকে, অপেশাদার ঐতিহাসিকরা আংশিক সময়ের ভিত্তিতে গবেষণা করেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্য পেশায় যুক্ত থাকেন।
ব্যক্তিগত এবং জীবিকাগত পার্থক্য:
পেশাদার ইতিহাসবিদরা বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে জাতি, রাষ্ট্র, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করেন।
অন্যদিকে, অপেশাদার ইতিহাসচর্চা তুলনামূলকভাবে স্থানীয় এবং সীমিত প্রেক্ষাপটে পরিচালিত হয়। স্থানীয় ইতিহাস, সমাজ এবং সংস্কৃতি এদের কাজের প্রধান বিষয়বস্তু।
পেশাদারী ইতিহাসবিদদের জীবিকা অনেকাংশে তাদের ইতিহাস চর্চার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু অপেশাদার ইতিহাসচর্চায় জীবিকার উপর এর প্রভাব উল্লেখযোগ্য নয়।
উপসংহার:
পেশাদারী ও অপেশাদারী ইতিহাসচর্চার মধ্যে মূল পার্থক্যগুলো উদ্ভব, আর্থিক সম্পর্ক, পদ্ধতি, সময় এবং জীবিকার ওপর নির্ভরশীল। উভয় ধরনের ইতিহাস চর্চাই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পেশাদার গবেষণা অতীতের সামগ্রিক ছবি প্রদান করে, এবং অপেশাদার গবেষণা স্থানীয় ইতিহাসের মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণে সহায়ক হয়।
4.উপনিবেশবাদ বলতে কী বোঝো? উপনিবেশবাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক আলোচনা করো।
উঃ
উপনিবেশবাদ:
ল্যাটিন শব্দ *Colonia* থেকে ইংরেজি *Colony* শব্দটির উৎপত্তি। বাংলায়, *Colony* শব্দের প্রতিশব্দ হল ‘উপনিবেশ’, যার অর্থ মূলত স্থানান্তরিত মানবসমাজের একটি অংশ।
উপনিবেশবাদ বলতে বোঝায়, একটি শক্তিধর দেশ কর্তৃক অন্য একটি নির্দিষ্ট এলাকা বা জনগোষ্ঠীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। এই নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য হল উপনিবেশিক দেশের অর্থনৈতিক শোষণ, কাঁচামাল ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, এবং উপনিবেশে তাদের বাজারের বিস্তার। পাশাপাশি, এটি উপনিবেশস্থাপনকারী দেশের রীতি, সংস্কৃতি, এবং জীবনযাপন পদ্ধতির প্রসার ঘটায়।
উনিশ শতকে ইউরোপের শক্তিধর দেশগুলি—ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া—বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলকে তাদের উপনিবেশে পরিণত করেছিল।
উপনিবেশবাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক:
সাদৃশ্য:
1.নতুন দেশের বিস্তার: পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর ভৌগোলিক আবিষ্কারের মাধ্যমে নতুন দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্য বাড়তে থাকে, এবং দেশগুলি উপনিবেশে পরিণত হয়। এভাবে উপনিবেশের আয়তন ও সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে এগুলি সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।
2.আর্থিক শোষণ: উপনিবেশ বা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যই আর্থিক শোষণ। উপনিবেশিক শক্তিগুলির স্বার্থের সংঘাতের ফলে যুদ্ধবিগ্রহ ঘটতে থাকে, এবং পরিণামে উপনিবেশগুলি সাম্রাজ্যের রূপ ধারণ করে।
3.ক্ষমতা ও আধিপত্য: ক্ষমতা ও আধিপত্য কায়েমের বাসনা উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে মূলগত মিলের একটি উপাদান।
বৈসাদৃশ্য:
1.ধারণার প্রাচীনত্ব: উপনিবেশবাদের ধারণাটি তুলনামূলকভাবে সাম্রাজ্যবাদের চেয়ে নতুন। গবেষকদের মতে, সাম্রাজ্যবাদের ধারণা অনেক প্রাচীন।
2.রূপভেদ: উপনিবেশবাদের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো রূপভেদ নেই, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের রয়েছে বিভিন্ন রূপ যেমন, অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ, সাময়িক সাম্রাজ্যবাদ, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ।
3.লক্ষ্য: উপনিবেশবাদের লক্ষ্য একটি দেশের বিস্তার ঘটানো, অপরদিকে সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্য হল অন্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা।
4.আধিপত্যের প্রকৃতি: উপনিবেশের ক্ষেত্রে মাতৃদেশ ও উপনিবেশের সম্পর্ক ভালবাসার হতে পারে, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে সম্পর্ক সাধারণত বিদেশি শাসকের মতো।
5.নিয়ন্ত্রণের কৌশল: উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রগুলি সাধারণত উপনিবেশে বসবাসকারী জনগণের মধ্যে থাকে এবং প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। তবে, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি সাধারণত সামরিক অভিযান চালিয়ে প্রত্যক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
5.1943 সালের বাংলার দূর্ভিক্ষের কারণগুলি লেখ। এতে ব্রিটিশদের ভূমিকা কী ছিল?
উঃ
ভূমিকা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ শাসনের অর্থনৈতিক শোষণ ও ভুল নীতির ফলে ১৯৪৩ সালে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যা "পঞ্চাশের মন্বন্তর" নামে পরিচিত। ১৩৫০ বঙ্গাব্দে সংঘটিত হওয়ায় এই দুর্ভিক্ষ এই নামে পরিচিত হয়। ধারণা করা হয়, এতে প্রায় ৪০ থেকে ৭০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের কারণ:
দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল বহুবিধ। প্রধান কারণগুলির মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ:
1. খাদ্য উৎপাদন হ্রাস: ঘূর্ণিঝড় এবং ফসলের মড়কের কারণে বাংলায় খাদ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যায়। বিশেষত, আমন ধানের ক্ষতি হওয়ায় খাদ্য সংকট চরমে ওঠে।
2. জাপানের আক্রমণের আশঙ্কা: ব্রিটিশরা ভেবেছিল যে জাপান ভারত আক্রমণ করতে পারে। এই ভয়ে তারা সীমান্ত অঞ্চলে "পোড়ামাটি নীতি" প্রয়োগ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা খাদ্য সরবরাহের সমস্যা বাড়িয়ে দেয়।
3. চার্চিলের ভূমিকা: ইতিহাসবিদ মধুশ্রী মুখার্জি এই দুর্ভিক্ষের জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে দায়ী করেন। চার্চিল বাংলায় খাদ্য পাঠানোর পরিবর্তে গ্রিসে খাদ্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন, যা বাংলার খাদ্য সংকটকে বাড়িয়ে তোলে।
4. সেনার জন্য খাদ্য রপ্তানি: যুদ্ধকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন মেটাতে ব্রিটিশ সরকার প্রচুর পরিমাণ খাদ্য রপ্তানি করায় দেশে খাদ্য সংকট আরও তীব্র হয়।
5. খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি: খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়া এবং মজুতদারির ফলে খাদ্যের মূল্য বেড়ে যায়। এর ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে খাদ্য কেনা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা:
ব্রিটিশ সরকারের দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় অদক্ষতা ও উদাসীনতা নিম্নলিখিতভাবে প্রতিফলিত হয়:
1. সতর্কবার্তা উপেক্ষা করা: বাংলার নেতা ফজলুল হক এবং কিছু ব্যবসায়ী সরকারের কাছে চালের সংকটের বিষয়ে সতর্কবার্তা দিলেও, সরকার তা উপেক্ষা করে।
2. ভুল দৃষ্টিভঙ্গি: সরকার মনে করেছিল, বাংলায় খাদ্য সংকট প্রকৃতপক্ষে নেই এবং মজুতদারিই সমস্যা। এই ভুল ধারণা কারণে সরকার সক্রিয় পদক্ষেপ নেয়নি।
3. মজুতদারি নিয়ন্ত্রণের অভাব: সরকার মজুতদারিদের বাধ্য করতে বা খাদ্য ছাড়াতে কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি।
4. বাংলার প্রতি অবহেলা: পূর্বের দুর্ভিক্ষের সময় বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্য সরবরাহ করা হলেও, এই দুর্ভিক্ষে বাংলার জন্য তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
5. ত্রাণকার্যের ধীরগতি: যখন খাদ্য সংকট দেখা দেয়, প্রাদেশিক সরকার ত্রাণকার্য শুরু করতে ধীরগতি দেখায়। এর ফলে ক্ষুধার্ত মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে যায়।
পঞ্চাশের মন্বন্তরে বাংলার দরিদ্র জনগোষ্ঠী ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিদেশি সহায়তাও দুর্ভিক্ষের তীব্রতা কমাতে পারেনি। ব্রিটিশ সরকারের সদিচ্ছার অভাব এবং ভুল নীতিই এই মন্বন্তরকে আরও ভয়াবহ করে তোলে।
6.চীনের ৪ঠা মে আন্দোলনের কারণ ও প্রভাব আলোচনা করো।
উঃ ভূমিকা:
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে, জাপান চীনের উপর আক্রমণ চালায়। যদিও চীন মিত্রপক্ষে যোগ দেয়, যুদ্ধে তাদের তেমন কোনও সুবিচার মেলে না। এই পরিস্থিতিতে, বিদেশি আধিপত্যের বিরুদ্ধে চীনের জাতীয়তাবাদী জনগণ চেন-তু-শিউ এর নেতৃত্বে ১৯১৯ সালের ৪ঠা মে পিকিং-এর 'তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ার'-এ সমবেত হয়ে এক আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলন ইতিহাসে '৪ঠা মে-র আন্দোলন' নামে পরিচিত।
আন্দোলনের পটভূমি ও কারণসমূহ:
এই আন্দোলনের পিছনে নানা কারণ ছিল। এর মধ্যে ছিল—
ইউয়ান-সি-কাই এর স্বৈরাচারিতা:
১৯১১ সালের বিপ্লবের পর সান-ইয়াৎ-সেন ইউয়ান-সি-কাইকে রাষ্ট্রপতি পদে বসতে দেন। কিন্তু ইউয়ান-সি-কাই ক্ষমতায় এসে সমস্ত সাংবিধানিক পদ্ধতি বাতিল করে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তার স্বৈরাচারিতার বিরোধিতা করায়, কুয়োমিনতাং দলের নেতা সহ আরও অনেককে হত্যা করা হয়।
কুয়োমিনতাং দলের নিষেধাজ্ঞা:
১৯১৩ সালে দ্বিতীয় বিপ্লবের সময় ইউয়ান-সি-কাই কুয়োমিনতাং দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এর ফলে চীনের জনগণের মধ্যে হতাশার সঞ্চার হয়।
জাপানের একুশ দফা দাবি:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান চীনের শান্টুং প্রদেশ দখল করে এবং ১৯১৫ সালে পুরো চীনের উপর আধিপত্য কায়েমের লক্ষ্যে একুশ দফা দাবি পেশ করে।
জাপানের সঙ্গে গোপন চুক্তি:
সম্রাট হওয়ার লোভে ইউয়ান-সি-কাই জাপানের সাথে গোপন চুক্তি করেন। এর পরিণতিতে দেশে তীব্র জনরোষ সৃষ্টি হয়।
চীনা শিল্পের সংকট:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় চীনের স্থানীয় শিল্প কিছুটা বিকাশ লাভ করে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে বিদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতায় তা হুমকির মুখে পড়ে।
প্যারিস শান্তি সম্মেলনে অবহেলা:
১৯১৯ সালে চীনের প্রতিনিধিরা প্যারিস শান্তি সম্মেলনে শান্টুং প্রদেশে জাপানি কর্তৃত্বের অবসান চায়, কিন্তু ইউরোপীয় কতৃপক্ষ তা অগ্রাহ্য করে।
আন্দোলনের সূচনা:
এই প্রেক্ষাপটে ১৯১৯ সালের ৪ঠা মে চেন-তু-শিউ’র আহ্বানে বিক্ষোভ শুরু হয়। দেশ ও বিদেশের চীনা ছাত্ররা এই আন্দোলনে সামিল হয়, এবং ক্রমে শ্রমিক শ্রেণির সক্রিয় অংশগ্রহণে আন্দোলনটি ব্যাপক আকার ধারণ করে।
আন্দোলনের প্রভাব:
দেশাত্মবোধ ও আধুনিকতার সূচনা:
এই আন্দোলন চীনে আধুনিক জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেমের জাগরণ ঘটায়।
সরকারের সমঝোতা:
জনমতের চাপে সরকার গ্রেপ্তার ছাত্রদের মুক্তি দেয় এবং ভার্সাই সন্ধিতে স্বাক্ষর না করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
কমিউনিস্ট পার্টির গঠন:
এই আন্দোলনের ফলেই কুয়োমিনতাং দলের পুনর্গঠন ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা ঘটে।
সাংস্কৃতিক উন্নতি:
চীনের প্রাচীন কনফুসীয় আদর্শের পরিবর্তে নতুন সংস্কৃতির দিকে ঝোঁক আসে, ফলে চীনা সমাজে ব্যাপক সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ঘটে।
উপসংহার:
৪ঠা মে-র আন্দোলন চীনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। ঐতিহাসিক ইমানুয়েল সু’র মতে, এই আন্দোলন চীনের সংস্কৃতিতে স্থায়ী পরিবর্তন আনে, যা পরবর্তীতে চীনা বিপ্লবকে একটি নতুন মাত্রা দেয়।
7.চীনের উপর আরোপিত বিভিন্ন অসম চুক্তিগুলি আলোচনা করো।
উঃ
ভূমিকা: চীন একসময় নিজেকে স্বর্গীয় দেশ হিসেবে গর্ব করলেও, বিদেশি শাসন অনেক পরে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়। উনিশ শতকে, চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পশ্চিমা শক্তিগুলি চীনে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে, যা চীনে বিদেশি সাম্রাজ্যের জন্ম দেয়। এই সময়ে বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে চীনের উপর অন্যায় শর্ত আরোপ করা হয়, যেগুলিকে "অসম চুক্তি" বা "বৈষম্যমূলক চুক্তি" বলা হয়।
অসম চুক্তির বৈশিষ্ট্য:
- এই চুক্তিগুলি একতরফা ছিল, কারণ চীনের সাথে কোনো আলোচনা ছাড়াই এগুলি চাপানো হয়েছিল।
- এই চুক্তিগুলি বিদেশি শক্তিগুলিকে চীনের উপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেয়।
- এসব চুক্তির ফলে চীনের সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
উল্লেখযোগ্য অসম চুক্তিসমূহ:
নানকিং-এর সন্ধি (১৮৪২):
প্রথম আফিম যুদ্ধে চীনের পরাজয়ের পর ব্রিটিশরা এই চুক্তি চাপায়।
শর্তাবলী:
- ক্যান্টন, সাংহাই, আময়, ফুচাও, ও নিংবো বন্দরে ইউরোপীয়দের বাণিজ্যের জন্য প্রবেশাধিকার দেয়া হয়।
- হংকংকে ব্রিটিশদের কাছে স্থায়ীভাবে হস্তান্তর করতে বাধ্য করা হয়।
- কো-হং প্রথা বাতিল করা হয়, এবং ব্রিটিশ বণিকদের পণ্যের কেনাবেচার অধিকার মঞ্জুর হয়।
- ব্রিটিশ আমদানি পণ্যের উপর ৫% শুল্ক ধার্য করা হয়।
টিয়েন সিয়েন চুক্তি (১৮৫৮):
দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের পর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স চীনের উপর এই চুক্তি চাপায়।
শর্তাবলী:
- চীন সরকার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়।
- বিদেশি বণিকদের জন্য আরও ১১টি বন্দর খোলা হয়।
- বিদেশিদের চীনে অবাধ ভ্রমণ এবং খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের অনুমতি দেওয়া হয়।
- বিদেশি বাণিজ্যের সুবিধার্থে শুল্ক হ্রাস করা হয়।
বগের চুক্তি (১৮৪৩):
নানকিং চুক্তির পরে ব্রিটিশরা আবার এই চুক্তি চাপায়।
শর্তাবলী:
- চুক্তি বন্দরগুলিতে বসবাসকারী ব্রিটিশ ও চীনা নাগরিকদের উপর চীনা আইন প্রযোজ্য হয় না।
- চীন ভবিষ্যতে অন্যান্য বিদেশি শক্তিকে যে সুবিধা দেবে, তা ব্রিটেনকেও প্রযোজ্য করতে রাজি করানো হয়।
ওয়াংসিয়া চুক্তি (১৮৪৪):
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের উপর এই চুক্তি চাপায়।
শর্তাবলী:
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চীনে রাষ্ট্রীয় সুবিধা দেওয়া হয়।
- চুক্তি বন্দরগুলিতে বসবাসরত বিদেশিরা আইনি ও বিচারিক বিষয়ে স্বাধীনতা লাভ করে।
হোয়ান পোয়া চুক্তি (১৮৪৪):
ফ্রান্স চীনের উপর এই চুক্তি চাপায়।
শর্তাবলী:
- ফরাসিদের জন্য দুটি বন্দর খোলা হয়।
- ফরাসি বণিকদের জন্য শুল্ক নির্দিষ্ট করা হয়।
উপসংহার: এসব অসম চুক্তির ফলে চীনের সার্বভৌমত্ব হ্রাস পায়, এবং চীনে বিভিন্ন বিদেশি শক্তির আধিপত্য ও বাণিজ্যিক স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত হয়।
8.ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ ফৌজের ভূমিকা আলোচনা করো।
উঃ
ভূমিকা:
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সুভাষচন্দ্র বসু এক অনন্য নাম। তাকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক এবং বিপ্লবী সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের তিনটি প্রধান ধারার মধ্যে অন্যতম ছিল বিদেশি শক্তির সাহায্যে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের প্রচেষ্টা। এই পথেই সুভাষচন্দ্র বসু তার স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যান।
স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান:
**রাজনীতিতে যোগদান:**
সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অর্জন করেও সুভাষচন্দ্র চাকরির প্রলোভন ত্যাগ করেন এবং মাত্র ২৪ বছর বয়সে ভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তিনি চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্বরাজ্য দলে যোগদান করেন।
**জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি:**
ছাত্র, যুব এবং শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে সুভাষচন্দ্র ১৯৩৮ সালে হরিপুরা অধিবেশনে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। পরবর্তী বছর ত্রিপুরি কংগ্রেস অধিবেশনে তিনি পুনরায় সভাপতির পদে নির্বাচিত হন।
**ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন:**
জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালে সুভাষচন্দ্র ও মহাত্মা গান্ধীর মতবিরোধ দেখা দেয়। এর ফলে ১৯৩৯ সালে তিনি কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামে একটি নতুন দল গঠন করেন এবং কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হন।
**দেশত্যাগ:**
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সুভাষচন্দ্র ব্রিটিশ শত্রু দেশগুলির সহায়তায় স্বাধীনতার পরিকল্পনা করেন। তিনি গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় ভাইপো শিশির বসুর সহযোগিতায় দেশ ত্যাগ করেন (১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারি)।
**জার্মানিতে সুভাষচন্দ্র:**
দেশত্যাগের পর তিনি কাবুল ও মস্কো হয়ে জার্মানির বার্লিনে পৌঁছান। সেখানে তিনি ‘ইন্ডিয়ান লেজিয়ন’ নামে একটি বাহিনী গঠন করেন এবং ‘নেতাজি’ উপাধি লাভ করেন।
**জাপানে সুভাষচন্দ্র:**
১৯৪৩ সালে তিনি জাপানে যান এবং বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সহযোগিতায় সেখানে যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাকে পূর্ণ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন।
**আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব:**
জাপানে অবস্থানকালে সুভাষচন্দ্র আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৪৩ সালে সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ সরকার নামে অস্থায়ী ভারত সরকার প্রতিষ্ঠা করেন।
**দিল্লি চলো অভিযান:**
‘দিল্লি চলো’ অভিযানের মাধ্যমে সুভাষচন্দ্র আজাদ হিন্দ ফৌজকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আহ্বান জানান এবং বলেন, “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।”
**উপসংহার:**
যদিও আজাদ হিন্দ ফৌজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, তবুও সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শ ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এর ফলে পরবর্তী সময়ে নৌ বিদ্রোহ ও অন্যান্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন আরও তীব্র হয়, যা ভারতকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়ক হয়।
9. সুয়েজ সংকটের কারণ ও প্রভাব আলোচনা করো। ৪+৪
উত্তর:
সুয়েজ সংকটের কারণ ও প্রভাব
ভূমিকা:
১৯৫৬ সালে ঘটে যাওয়া সুয়েজ সংকট ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক এবং সামরিক সংঘাত। এটি মূলত মিশরের রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসেরের সুয়েজ খাল জাতীয়করণের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে শুরু হয়। সুয়েজ খাল ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যে সংযোগকারী একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ জলপথ।
কারণসমূহ:
১. সুয়েজ খাল জাতীয়করণ: মিশরের রাষ্ট্রপতি নাসের সুয়েজ খালকে ব্রিটিশ-ফরাসি মালিকানার হাত থেকে মুক্ত করে জাতীয়করণের ঘোষণা দেন।
২. পশ্চিমা শক্তির উদ্বেগ: খালের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশঙ্কায় যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স অসন্তুষ্ট হয়।
৩. ইসরায়েলের উদ্বেগ: নাসেরের নেতৃত্বে মিশরের আরব জাতীয়তাবাদ ইসরায়েলের জন্য হুমকি তৈরি করেছিল।
৪. আর্থিক কারণ: নাসের আসওয়ান বাঁধ নির্মাণের জন্য তহবিল সংগ্রহে বাধ্য হয়েছিলেন, যা যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন প্রত্যাহার করেছিল।
৫. মহাশক্তির দ্বন্দ্ব: স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সোভিয়েত ইউনিয়ন নাসেরকে সমর্থন জানায়, যা পশ্চিমা শক্তিগুলোর বিরোধিতা বাড়ায়।
প্রভাবসমূহ:
১. রাজনৈতিক প্রভাব: মিশর তার ভূখণ্ডের উপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
২. আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেয়, যা জাতিসংঘের গুরুত্ব বৃদ্ধি করে।
৩. ইউরোপীয় শক্তির পতন: যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব হ্রাস পায়।
৪. ইসরায়েলের নিরাপত্তা প্রশ্ন: ইসরায়েল সামরিকভাবে শক্তিশালী হলেও আরব জাতীয়তাবাদ আরও জোরদার হয়।
৫. মধ্যপ্রাচ্যে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা: এই সংকট সোভিয়েত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে আরও তীব্র করে তোলে।
উপসংহার:
সুয়েজ সংকট শুধুমাত্র একটি সামরিক সংঘাত নয়, এটি সাম্রাজ্যবাদের পতনের এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর শক্তি প্রদর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। এটি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন মাত্রা উন্মোচন করে।
10. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। এই যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কী ছিল? ৫+৩
উত্তর:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ভারতের ভূমিকা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে সংঘটিত হয়, যা পাকিস্তানের শোষণমূলক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিদের স্বাধীনতার আন্দোলন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর দমন অভিযান চালায়। এর ফলে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। যুদ্ধটি প্রায় ৯ মাস ধরে চলে এবং ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
ভারতের ভূমিকা:
১. শরণার্থীদের সহায়তা: যুদ্ধ চলাকালীন প্রায় ১ কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়, যা ভারত মানবিক সহায়তা দেয়।
২. রাজনৈতিক সমর্থন: ভারত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানায় এবং বিভিন্ন দেশকে বাংলাদেশের পক্ষে আনতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালায়।
৩. সামরিক সহায়তা: ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারত সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ায় এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালায়।
৪. পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিতকরণ: ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে পাকিস্তান মাত্র ১৩ দিনের যুদ্ধে পরাজিত হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
উপসংহার:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে কেবল বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা দুই দেশের সম্পর্ককে চিরস্থায়ীভাবে গভীর করে তুলেছে।
11. ব্রিটিশ শাসনামলে আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। ৮
উত্তর:
ব্রিটিশ শাসনামলে আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা
সূচনা:
ব্রিটিশ শাসনকাল ছিল ভারতের জন্য এক অবিচার এবং শোষণের যুগ, বিশেষত আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের জন্য। এই সম্প্রদায়গুলো ব্রিটিশ সরকারের নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার ছিল এবং তাদের জীবনে বিপুল দারিদ্র্য ও অশিক্ষা বিরাজ করেছিল। ব্রিটিশ শাসকেরা তাদের মানবাধিকার ও সামাজিক মর্যাদাকে উপেক্ষা করে তাদের জীবনযাত্রাকে অত্যন্ত কঠিন করে তোলে।
১. ভূমির অধিকার হরণের ফলে শোষণ: ব্রিটিশ শাসনকারীরা আদিবাসী সম্প্রদায়ের জমি কেড়ে নিয়ে তাদের ভূমিহীন করে তোলে, যার ফলে তারা শোষিত হতে থাকে।
২. শ্রমের শোষণ: আদিবাসীরা ও দলিতরা মূলত কৃষক ও শ্রমিক হিসেবে কাজ করত, কিন্তু তাদের শ্রমের ফল তারা পেত না।
৩. শিক্ষার অভাব: ব্রিটিশরা আদিবাসী ও দলিতদের জন্য কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেনি, ফলে তারা অশিক্ষিত ও অন্ধকারে রয়ে গিয়েছিল।
৪. বৈষম্য ও শোষণ: সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষদের দ্বারা এই সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি বৈষম্য ছিল অবধারিত। ব্রিটিশ সরকারও এর বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেননি।
৫. সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ক্ষতি: ব্রিটিশরা আদিবাসী সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জীবনধারণের প্রথা ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, যা তাদের জন্য আরও কষ্টকর ছিল।
৬. বিরোধী বিদ্রোহের সূচনা: অত্যাচারের বিরুদ্ধে আদিবাসী সম্প্রদায় সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫) এবং মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৯-১৯০০) সহ নানা বিদ্রোহে অংশ নেয়।
৭. দলিত সম্প্রদায়ের অধিকার সংগ্রাম: দলিতরা তাদের অধিকার অর্জনের জন্য বিভিন্ন আন্দোলন শুরু করে, যার মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলন উল্লেখযোগ্য।
৮. ব্রিটিশ শাসনের অবসান: ব্রিটিশ শাসন শেষে, কিছুটা হলেও এই সম্প্রদায়গুলোর অবস্থার উন্নতি ঘটে, তবে অনেক সমস্যা এখনও রয়ে যায়।
উপসংহার:
ব্রিটিশ শাসনকাল ছিল আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের জন্য অত্যন্ত কঠিন সময়। তাদের জমি, জীবন, শিক্ষা, এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ব্রিটিশ শাসকরা কেড়ে নিয়েছিল। তবে, এই সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে এবং তারা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর কিছু উন্নতি হলেও, ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব তাদের জীবনে দীর্ঘদিন রয়ে যায়।
12. মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার (১৯১৯)-এর বৈশিষ্ট্যগুলি বর্ণনা করো। পাশাপাশি এই আইনের সীমাবদ্ধতাগুলি আলোচনা করো। ৪+৪
উত্তর:
মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার (১৯১৯)-এর বৈশিষ্ট্য এবং সীমাবদ্ধতা
ভূমিকা:
মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার, ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস করা একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন, যা ভারতের রাজনৈতিক কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন আনার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল। এই সংস্কারের মাধ্যমে ভারতীয় জনগণের জন্য কিছু রাজনৈতিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, তবে ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃত পরিবর্তন ঘটেনি। এটি প্রথম দফায় ভারতীয়দের অংশগ্রহণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়, তবে তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রাপ্তির পথ প্রশস্ত হয়নি।
বৈশিষ্ট্যগুলি:
১. ডুয়াল গভর্নমেন্ট (Dyarchy) ব্যবস্থা: প্রদেশ স্তরে দু’টি বিভাগে ক্ষমতা ভাগ করা হয়েছিল—একটি বিভাগের প্রশাসন ছিল ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের হাতে এবং অন্যটি ছিল ভারতীয় প্রতিনিধিদের হাতে।
২. সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলি: এই সংস্কারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সংসদে ভারতীয় প্রতিনিধির সংখ্যা বাড়ানো হয়েছিল, তবে এই প্রতিনিধিরা বাস্তবিক ক্ষমতা পায়নি।
৩. উচ্চতর বিচার বিভাগ: ভারতীয়দের জন্য কিছু উচ্চতর বিচার বিভাগের সুযোগ তৈরি করা হয়েছিল, যা তাদের বিচারিক ক্ষমতায় অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল।
৪. নির্বাচন ব্যবস্থার প্রসার: পুরনো নির্বাচনী ব্যবস্থায় কিছু সংশোধন এনে বেশি সংখ্যক ভারতীয় নাগরিকদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
সীমাবদ্ধতা:
১. পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের অভাব: এই সংস্কারের মাধ্যমে ভারতের শাসনে ব্রিটিশদের পূর্ণ ক্ষমতা থেকে কোনো হ্রাস ঘটেনি, যা ভারতীয়দের পূর্ণ স্বাধীনতার পথে বাধা ছিল।
২. ডুয়াল গভর্নমেন্টের সীমাবদ্ধতা: প্রদেশ স্তরে ক্ষমতার বিভাজন হলেও, প্রকৃত ক্ষমতা ছিল ব্রিটিশ গভর্নরের হাতে, যা কার্যকরী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছিল।
৩. সংসদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা: ভারতীয় প্রতিনিধিরা কেন্দ্রীয় সংসদে অংশগ্রহণ করলেও, তাদের হাতে কোনো বাস্তবিক ক্ষমতা ছিল না। তারা শুধুমাত্র প্রস্তাব পেশ করতে পারতেন, কিন্তু কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ছিল না।
৪. বৈষম্যপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থা: নির্বাচনী ব্যবস্থায় কোনো ভারতীয় গরীব বা শ্রমজীবী মানুষ অংশগ্রহণের সুযোগ পায়নি, শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের কিছু মানুষ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারতেন।
উপসংহার:
মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার (১৯১৯) ভারতের রাজনৈতিক কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন আনলেও, এটি ভারতীয়দের পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের পথ প্রশস্ত করেনি। এই সংস্কারের মাধ্যমে কিছু রাজনৈতিক অধিকার বাড়ানো হলেও, ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃত পরিবর্তন ঘটেনি এবং এর সীমাবদ্ধতা ভারতীয় জনগণের জন্য অল্প সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। এটি সামগ্রিকভাবে ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছিল, কারণ ভারতীয়রা বুঝতে পারে যে, তাদের অধিকার অর্জনের জন্য আরও বৃহত্তর সংগ্রাম প্রয়োজন।
13. ট্রুম্যান নীতি কী? মার্শাল পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলি কী ছিল? ৪+৪
উত্তর:
ট্রুম্যান নীতি এবং মার্শাল পরিকল্পনা
ভূমিকা:
বিশ্বযুদ্ধের পর, ইউরোপের অনেক দেশ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের প্রতি প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। এই অবস্থায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান ১৯৪৭ সালে ট্রুম্যান নীতি ঘোষণা করেন, যা বিশ্বের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি নির্দেশ করে। এরপর, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী জর্জ মার্শাল ১৯৪৮ সালে ইউরোপের পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য মার্শাল পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এই দুটি নীতি বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশী নীতি ও সহযোগিতার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।
ট্রুম্যান নীতি:
১. কমিউনিজমের বিস্তার রোধ: ট্রুম্যান নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিজম বিস্তার রোধ করা এবং ইউরোপ ও অন্যান্য অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব প্রতিষ্ঠা করা।
২. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে কোনো দেশের স্বাধীনতা রক্ষা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে চেয়েছিল, বিশেষত যেসব দেশ কমিউনিজমের ঝুঁকির মুখে ছিল।
৩. গ্রিস ও তুরস্কের সাহায্য: ১৯৪৭ সালে ট্রুম্যান নীতি অনুসারে গ্রিস ও তুরস্ককে মার্কিন আর্থিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করা হয়, যাতে তারা কমিউনিস্ট প্রভাব থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে।
৪. বিশ্বব্যাপী স্থিতিশীলতা: ট্রুম্যান নীতির উদ্দেশ্য ছিল, যে কোনো রাষ্ট্রের ভিতর কমিউনিজমের আগমন রোধ করা, যাতে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
মার্শাল পরিকল্পনা:
১. অর্থনৈতিক পুনর্গঠন: মার্শাল পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য ১৩ বিলিয়ন ডলার সাহায্য প্রদান করে।
২. বেকারত্বের হার কমানো: পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল, ইউরোপে বেকারত্বের হার কমানো এবং ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা।
৩. কমিউনিজমের বিস্তার রোধ: ইউরোপীয় দেশগুলো পুনর্গঠিত হলে, তারা কমিউনিস্ট প্রভাবের আওতায় আসবে না, এমন লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
৪. বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা: ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং একে অপরের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্য ছিল মার্শাল পরিকল্পনা।
উপসংহার:
ট্রুম্যান নীতি এবং মার্শাল পরিকল্পনা ১৯৪০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির দুইটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল। ট্রুম্যান নীতি সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিজমের বিস্তার রোধে ভূমিকা রাখে, আর মার্শাল পরিকল্পনা ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন নিশ্চিত করে। এ দুইটি নীতি শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করেনি, বরং বিশ্বব্যাপী শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করেছে।
14.সমাজ সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান আলোচনা করো। ৮
উত্তর:
রাজা রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কারক হিসেবে অবদান
ভূমিকা:
রাজা রামমোহন রায় ছিলেন একজন মহান সমাজ সংস্কারক, যিনি ১৮শতকের শেষের দিকে এবং ১৯শতকের শুরুর দিকে ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন অসামাজিক ও প্রতিকূল প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান, সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল, এবং ধর্ম, সংস্কৃতি ও সামাজিক দিক থেকে সম্যক জ্ঞান অর্জনকারী একজন নেতা ছিলেন। তাঁর অবদান ভারতীয় সমাজে মৌলিক পরিবর্তন আনার পথে একটি বড় ধাপ ছিল।
অবদানসমূহ:
১. সতি প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন: রাজা রামমোহন রায় ১৯১০ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছে সতী প্রথা নিষিদ্ধ করার জন্য প্রস্তাব করেছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টার ফলে ১৮২৯ সালে সতী প্রথা নিষিদ্ধ হয়, যা ভারতীয় সমাজে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল।
২. ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা: ১৮২৮ সালে তিনি ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা হিন্দু ধর্মের মধ্যে যুক্তিবাদ, মানবিকতা এবং সামাজিক ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জাগানোর চেষ্টা করেছিল। এটি সনাতন ধর্মের নানা কুসংস্কার এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে এক বিপ্লবী আন্দোলন ছিল।
৩. শিক্ষার প্রসার: রাজা রামমোহন রায় বিশেষভাবে নারী শিক্ষার প্রচারে আগ্রহী ছিলেন। তিনি বাংলায় প্রথম বিদ্যালয়ে শিক্ষার জন্য উদ্যোগী হন এবং ইউরোপীয় শিক্ষার প্রবর্তন করেন, যাতে ভারতীয় সমাজের উন্নতি হয়।
৪. হিন্দু আইন সংস্করণ: তিনি হিন্দু ধর্মের শাস্ত্রের প্রতি এক বৈষয়িক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলেন, যাতে শুধু পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত না হয়। তিনি হিন্দু সমাজের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রচার চালান।
৫. নারী মুক্তির আন্দোলন: নারী অধিকার এবং সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে রাজা রামমোহন রায় গভীর মনোযোগ দেন। তিনি নারীদের শিক্ষা, সম্পত্তির অধিকার এবং উন্নতির জন্য লড়াই করেন।
৬. ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি: রামমোহন রায় ধর্মের এক বিশাল সংস্করণ করেছিলেন, যেখানে তিনি মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে সকল ধর্মকে সমান মূল্য দিয়েছিলেন।
৭. ভারতীয় সংস্কৃতির উন্নতি: তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির উন্নতির জন্য পশ্চিমা সভ্যতা ও শাস্ত্রের সঙ্গে একধরনের সমন্বয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
৮. ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রচেষ্টা: তিনি ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের অধিকারের জন্য সোচ্চার ছিলেন, যা ভারতীয় স্বাধীনতার আন্দোলনের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিল।
উপসংহার:
রাজা রামমোহন রায় ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক, যিনি ভারতীয় সমাজের অন্ধকার প্রথাগুলোর বিরুদ্ধে এক নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন। তাঁর উদ্যোগের ফলে ভারতীয় সমাজে নানা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে, বিশেষত নারী স্বাধীনতা, শিক্ষা, এবং ধর্মীয় উন্মুক্ততা সংক্রান্ত বিষয়ে। তিনি ছিলেন এক মহান যুগপ্রবর্তক, যিনি শুধু সমাজকেই পরিবর্তন করেননি, বরং ভারতীয় সংস্কৃতিকে একটি নতুন দৃষ্টিতে দেখার জন্য আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন।

